রৌনদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়


র্তমানে একটা কথা প্রায়ই উঠে আসে " আজকাল ছেলে মেয়ে গুলো বাংলা গান শোনে না, সব ক্ষেত্রেই  হিন্দি গানের ছড়াছড়ি" আবার কেউ কেউ বলেন " বাঙালি হয়েও পপ বা ইংলিশ গানের দিকেই এদের ঝোঁক বেশি"......
তবে পাশ্চাত্য সুরের প্রতি মোহগ্রস্থতা মানেই নিজের শেকড় কে ভুলে যাওয়া , তা বোধ হয় একদমই নয়।

এসব কথার জবাব কবিগুরু কিন্তু অনেকদিন আগেই দিয়ে গেছেন। "গান সাধার বাধা আইন"  কবিগুরু কোনোদিন মানেন নি তাই বোধ হয় তিনি এত সুন্দর কতগুলো গান তিনি উপহার দিতে পেরেছিলেন।.....
রবি ঠাকুর বরাবর পুরোনো ভেঙে নতুন গড়তে চেয়েছেন । তিনিই বলেছেন " আমরা নুতন যৌবন এর দূত"।

রবীন্দ্রনাথ যখন সতেরো বছর বয়সে বিদেশ যান ব্যারিস্টারি পড়তে।অভিভাবক হিসেবে তার মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাথে ছিলেন।তখন তিনি নানা ভাবে  নানা মানুষের সান্নিধ্যে আসেন। পাশ্চাত্য এর সুর তাকে বরাবরই আকৃষ্ট করে। ১৮৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেড় বছর তিনি ইংল্যান্ডে ছিলেন। পরে উচ্চশিক্ষা শেষ না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। যে উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, সেটি খুব একটা সিদ্ধ না হলেও এই সময় রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের সাহিত্যিকদের দ্বারা যে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে তিনি শেক্সপিয়রসহ পাশ্চাত্যের সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করেন, যেগুলো পরবর্তীকালে তাঁর গান রচনায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

"আমি যথার্থই য়ুরোপীয় সঙ্গীতের রসভোগ করিয়াছি তখনই বারম্বার মনের মধ্যে বলিয়াছি ইহা রোমান্টিক ইহা মানবজীবনের বিচিত্রতাকে গানের সুরে অনুবাদ করিয়া প্রকাশ করিতেছে। আমাদের সংগীতে কোথাও কোথাও সে চেষ্টা নাই যে তাহা নহে, কিন্তু সে চেষ্টা প্রবল ও সফল হইতে পারে নাই।"


 স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত কবি রবার্ট বার্নস রচিত বিখ্যাত গান "Auld Lang Syne " রবীন্দ্রনাথের মানসপটে ভীষন ভাবে দাগ কেটে ছিল।  গানটি এতটাই জনপ্রিয় যে শুধু স্কটল্যান্ডবাসী নয়, ইংরেজি ভাষার অনেক দেশর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই গান গাওয়া হয়।
রবি ঠাকুর ওই গানটির সুর এক রেখে বদলে দিলেন ভাষা। 
সৃষ্টি হলো নতুন গান " পুরানো সেই দিনের কথা"  (১৮৮৫) । যার সাথে আমরা সবাই পরিচিত।
তার অনুবাদ এতটাই প্রাণবন্ত, শুনে বোঝার কোনো জো নেই যে এটি বিদেশি সুরাশ্রয়ী গান। 

স্কটিশ কবি বানার্স এর "Ye Banks and Braes" এর সুরের আদলে আরেকটি গান তৈরি করেছিলেন কবিগুরু। মূল গানটি কবি বার্নস তিনটি সংস্করণে রচনা করেছিলেন এবং তিনটি সংস্করণই ১৭৯১ সালে প্রকাশিত হয়। 
১৮৮২ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘বিলাতি ভাঙা' রাগে  এই গানটির সুর কে কাজে লাগিয়ে তিনি তৈরি করেন   "ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে" গানটি। 
মূল গানে কবি বার্নস নস্টালজিয়া ও প্রেমের আবেগ-অনুভূতি ব্যক্ত করলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অনুবাদে প্রাকৃতিক নিসর্গের সৌন্দর্য কেই তুলে ধরছেন ।
"The Caledonian Hunt’s delight" এর সুরে সুরারোপিত এই গানটি সুর হবহু বাংলা সংস্করণে বজায় রেখেছেন কবি গুরু।

প্রতি বছর বসন্তে  চির-রোমান্টিক বাঙালির মনের অজান্তেই যে গানটি  বেজে ওঠে 
 --- ‘আহা আজি এ বসন্তে’ ।
গানটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। এটি রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’ নাটকের সপ্তম দৃশ্যে পরিবেশিত হয়েছে।
বিখ্যাত আইরিশ কবি থমাস মূরের “Go Where Glory Waits Thee" (১৮০৭) অনুকরণে রচিত হয়েছে বিখ্যাত এই গানটি 'Maid of the Valley' এর ভিত্তিতে সুরারোপিত।

রবি ঠাকুর বিদেশ থেকে ফেরার পর তার বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরণায়  ১৮৮০ সালে লিখতে শুরু করেন " বাল্মীকি প্রতিভা" নামক গীতিনাট্য টি। রবীন্দ্রসৃষ্ট গীতিনাটক গুলোর মধ্যে এটি সর্বপ্রথম। বলা যায় এই নাটকটি দিয়ে তিনি পাশ্চাত্য সুরের প্রয়োগ ও সংমিশ্রণ এর এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন।

এটির প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় যে ডাকাত দলের গলায় একটি গান " এনেছি মোরা এনেছি দেখো" । এই গান টি রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকে ব্যবহৃত এই গানটি পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে ভেঙে রচিত হয়েছে বলে বিদগ্ধজনেরা বলে থাকেন।  রচনাকাল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ। সে ক্ষেত্রে গানটি যে বহুল শ্রুত ও তুমুল জনপ্রিয় “For He's a Jolly Good Fellow” এর অনুকরণে এমন ভাবাটা কিছু অমূলক নয়। ইংরেজি এই গানটি বিয়ে, জন্মদিন বা অন্য যেকোনো আয়োজনে প্রিয়জনকে অভিনন্দন জানাতে গাওয়া হয়ে থাকে। ইংরেজি গানটির একটি ব্রিটিশ সংস্করণ ও একটি আমেরিকান সংস্করণও আছে। মূল ইংরেজি গানটি একটি ফরাসি গান থেকে জনপ্রিয়তা লাভ করে ইংরেজি ভাষাতেও জায়গা করে নিয়েছে। শোনা যায়, ফ্রান্সের রানি মারি এন্তোনে একদা তার এক দাসীকে এই গানটি গাইতে শোনেন। তখন গানটি রানির খুব ভালো লেগে যায় এবং তার মাধ্যমেই গানটি জনসমাজে পরিচিতি পায় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 
বাল্মীকি প্রতিভাতে প্রথম দৃশ্য ব্যবহৃত হওয়া আরেকটি গান "কালী  কালী বলো রে আজ" ব্রিটিশ গান Nancy Lee গানের ছায়া অবলম্বনে রচিত হয়েছে। ফ্রেডেরিস ওয়েদারলির লেখা ও স্টিফেন অ্যাডামসের সুরারোপিত এ গানটি ।

বাল্মীকি প্রতিভাতে সফল হয়ে পরবর্তীকালে তিনি কালমৃগয়া নামক আরেকটি গীতিনাট্য লেখেন। সেখানেও তিনি পাশ্চাত্য সুরের সংমিশ্রণ ঘটান।
কাল-মৃগয়া’ নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে ব্যবহৃত "ও ভাই দেখে যা' গানটির সুর সংগ্রহ করা হয়েছে বিখ্যাত The British Grenadiers শিরোনামের গানটি থেকে। এই গানটি ব্রিটিশ ও কানাডার সেনাবাহিনীর রণ সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
'তবে আয় সবে আয়' বিখ্যাত ইংরেজ কবি জন পীলে রচিত 'The English Hunting Song" অবলম্বনে রচিত।দল বেঁধে শিকারে যাওয়াকালীন এ গানটি সমস্বরে গীত হয়ে থাকে। বাংলাতেও এই ভাবটিই কবি ধারণ করেছেন, সেখানেও ঢাল-তলোয়ার প্রভৃতি অনুষঙ্গের কথা বলা হয়েছে।

কালমৃগয়া’ নাটকের ষষ্ঠ দৃশ্যে ‘সকলি ফুরালো স্বপনপ্রায়’ গানটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই গানটি লেডি ক্যারোলিন কেপেল রচিত আইরিশ (বা কেউ কেউ বলেন স্কটিশ) গান ‘Robin Adair’ অবলম্বনে রচিত হয়েছে। গানটি কবি ক্যারোল ডালির বিখ্যাত Eileen Aroon গানের সুর অবলম্বনে রচিত। মূল গানটি জেন অস্টেনের উপন্যাস Emma-তে ১৮১৫ সালে ব্যবহার করা হয়েছে। 

লেডি কেপেল গানটি তাঁর স্বামী রবিন এডেইরকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন। রবিন ছিলেন নিচু বংশের। পারিবারিক বিরোধিতা সত্ত্বেও লেডি কেপেল রবিনকে বিয়ে করেন। স্বামীকে নিয়েই এই গানটি তিনি রচনা করেন ১৭৫০ এর দশকে।বিখ্যাত এই গানটিকে অবলম্বন করে রবীন্দ্রনাথও লিখে ফেললেন এই গভীর বিষাদ জাগানিয়া গান ‘সকলি ফুরালো, স্বপনপ্রায়’।

রবি ঠাকুর বরাবরই চাইতেন অচলায়তন ভাঙতে।

"এশিয়ার প্রায় সকল দেশেই আজ পাশ্চাত্য ভাবের সঙ্গে প্রাচ্যভাবের মিশ্রণ চলছে। এই মিশ্রণে নূতন সৃষ্টির সম্ভাবনা। … আমাদের সাহিত্যে এটা ঘটেছে, সঙ্গীতেও কেন ঘটবে না বুঝি না।"

তিনি পাশ্চাত্য সুরকে  সাগ্রহে গ্রহন করে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের ব্যবধান  যেমন অনেকটাই দূর করে দিয়েছেন তেমন বিদেশি সুরাশ্রয়ী গান গুলো  কবিগুরুর নিজস্ব গুনেই মৌলিক হয়ে রয়েছে ।

Comments

পাঠকের পছন্দ