সম্পাদকীয়



"চুম্বনশাসিত ঠোঁট
 স্মৃতিপদ্মের ওপর ভ্রমর বসেছে 
 তার মৃদু গুঞ্জনে ভায়োলিন বেজে ওঠে বিরহমাত্রায়
বয়ঃসন্ধিতে না, পরের স্টেশনে থামে সম্পর্ক-লোকাল
স্মৃতিমন্থর এক গানের কম্পার্টমেন্ট সেখানে রয়েছে 
চুম্বনশাসিত গান-- স্মৃতিমাতৃক স্বরলিপি 
চোখ দিয়ে শুনে নেওয়া, শুঁকে নেওয়া, চেটে নেওয়া গান
গানের ভ্রূণের মতো অপেক্ষায় আছি এতকাল 
তুমি এসে গেয়ে যাবে বলে... "

(স্মৃতিটোরিয়াম) 

এই কবিতাটি যখন লিখেছিলাম, তখন আপাদমস্তক একটা গান আমাকে আকণ্ঠ পান করে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিল নৈঃশব্দ্যের দিকে! আমি সেই নৈঃশব্দ্যকেও সুর করে গেয়ে উঠেছিলাম তখন। আর আমার দু-চোখ ভর্তি সেই গান ঝাপসা হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল ফোঁটায় ফোঁটায়।
আসলে গান এক এমনই দৈব উপশম যা আমাদের যেকোনও মানসিক অবস্থার সাথে খাপ খেয়ে যায় অবলীলায়। গানই সেই শুশ্রূষা, যা আমাদের দৈনন্দিন অনেক বিকারকে প্রশমিত করে দিতে পারে তার অনুরণনের পালক দিয়ে! আমি নিজে গান জানি না। শিখিনি। গানের জগতের মানুষও আমি নই। কিন্তু গান আমার জন্মলগ্ন থেকেই আমার মানসিক শান্তির মতো, মায়ের মতো করে আমার জীবন জুড়ে ছেয়ে রয়েছে! আমার মা গান গাইতেন। আমার বাবারও গানের প্রতি অনুরাগ কম ছিল না! আমি নিজেও গানের কাছে নিজের আত্মশুদ্ধির একটা পথ খুঁজে পাই! তাই আমার নিজের বহু কবিতায় ও গদ্যে গানের অনুষঙ্গে বহু বহু শব্দ বাক্য ও সংযোগ এসে গিয়েছে বিভিন্ন ভাবে! এটা 'গান' বিষয়টির প্রতি আমার একটি দুর্বলতা হিসেবে অবিহিত করলেও কোথাও কোনও ভুল হবে না!
'পান্থজন'-এর প্রথম সংখ্যাটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন একটা দুর্দম উদ্দীপনা কাজ করেছিল আমাদের মধ্যে! কয়েকদিনের মধ্যেই তখন জোগাড় করে নেওয়া গিয়েছিল 'কোয়ারেন্টাইন যাপন'কালের লেখাপত্র! প্রায় ৫২ জনের লেখা সমৃদ্ধ সেই আত্মপ্রকাশ সংখ্যাটি দারুণ হৈ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে মুখ দেখাল এই বছরেরই ২৫ বৈশাখে। সেই সময়েই আমরা স্থির করেছিলাম যে প্রতিমাসে 'পান্থজন'-এর একটি করে সংখ্যা প্রকাশ করা হবে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ দেখে।
কিন্তু ইতিমধ্যে আমরা লকডাউন পর্ব কাটিয়ে বর্তমানে আনলক পর্বের এক নতুন অনিশ্চয়তার ভেতর ঢুকে গিয়েছি। অথচ প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে! এদিকে আমফান ঝড়ে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ! এই ভয়ংকর প্রাকৃতিক সাইক্লোনের শিকার হয়ে গৃহহারা, স্বজনহারা, সহায়-সম্বল-অবলম্বনহীন হয়ে পড়েছে বহু সংখ্যক মানুষ। তার ওপর এই চলতি বছরেই আমাদের বেশ কিছু অগ্রজ কবির প্রয়াণ ঘটে গেল! বেশ কিছু বড় মাপের অভিনেতা চলে গেলেন জীবনের রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে! কত কত মানুষের চাকরি চলে গেল! মানসিক অবসাদে ভারাক্রান্ত মন আমাদের বিবেকের ভেতর ক্রমশ ছুরি চালিয়ে রাখছে প্রতিদিন। 
এই দ্বিতীয় সংখ্যার বিষয় হল 'গান'! গানের যে বিস্তৃত ভূবন, তার কোনও নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে আমরা চেয়েছিলাম যে, যথাসম্ভব তার বেশিরভাগ পরিসরকে পরিক্রমা করার মতো একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা প্রকাশ করতে! সেই মতো ভেবে-চিন্তে আমার মতো এক অতি আনকোরা ও অনভিজ্ঞ সম্পাদক এই অসাধ্যসাধনের প্রয়াস নিয়েছিল! কিন্তু তার হয়ত কয়েক শতাংশ মাত্রই সার্থকতা পেয়েছে এই সংখ্যাটি! বর্তমানের এই অনিশ্চয়তার টানাপোড়েনের জীবনযুদ্ধ সাহিত্যের, শিল্পের, সংস্কৃতির জগতেও বিষাদের প্রলেপ লাগিয়ে রেখেছে! তাই যথাসম্ভব চেষ্টা করেও অনেক গুণী মানুষের লেখা আমি জোগাড় করতে সক্ষম হলাম না! কিন্তু প্রাপ্তির মধ্যে যাদের লেখা পেলাম, তাদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ রইল না আমার! অনেক অনেক তাগাদার তাড়না ভোগ করিয়ে তাদের কাছ থেকে লেখা আদায়ের জন্য এইবারে তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ আমি এখানে হাতছাড়া করব না কোনোমতেই! প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব দর্শন, চিন্তা, অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনার ক্ষরণ ও সাধনের অন্তর্লীন অনুভূতি ঢেলে দিয়েছেন নিজেদের লেখায়! তাই এই সংখ্যার সকল লেখককে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ ও নমস্কার জানাই।
পরিশেষে বলি, আমরা এই মুহূর্তে যে ধরনের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে দাঁড়িয়ে যদি সংগীত ও 'পান্থজন'-এর বর্তমান সংখ্যাটি পাঠকদের মনে সামান্য তৃপ্তিরও উদ্রেক ঘটাতে সক্ষম হয়, তাহলে আমার এই প্রয়াসটি সফল হয়েছে বলে মনে করব! 

গৌরব চক্রবর্তী 

Comments

পাঠকের পছন্দ