সঞ্চারী গোস্বামী



ছোটবেলায় যারাই গান নিয়ে দায়ে পড়ে পড়াশোনা করেছে, তারাই যে সংজ্ঞাটা প্রথম পড়েছে তা হল সঙ্গীত; মানে নৃত্য-গীত-বাদ্যের সমাহার। দায়ে পড়ে করেছে এইজন্য বললাম, যে, ছোটবেলায় দায়ে না পড়লে গান নিয়ে পড়াশোনা কেউ করে না। বড় হয়ে ভালোবেসে যাই পড়ি না কেন, তার জন্য সংজ্ঞা মুখস্থ করি না আমরা। ভালোবেসে যা পড়া হয়, তাতে বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আপনি আসে। খাবার মুখে দেওয়া থেকে হজম হওয়া অব্দি যেমন অনেকগুলো স্তর, যার প্রধান হল আত্তীকরণ, তেমনি কোনো বিষয় পড়ার পরও এমন আত্তীকরণ হলে আর আলাদা করে সংজ্ঞা মনে রাখার দায় থাকে না, সব কথা আপনাআপনি মনে থেকে যায়। 

সঙ্গীতের সংজ্ঞায় যাই থাক, আমরা সাধারণ অর্থে সঙ্গীত বলতে কেবল গান, অর্থাৎ গীত বুঝি। আমার নিজের পড়াশোনার বিষয় পদার্থবিদ্যা বলে সেখান থেকেই একটা তুলনা টানি। যে তুলনাটা টানব, তার জন্য খুব বেশি পদার্থবিদ্যা জানবার দরকার নেই, আমি-আপনি সবাই ছোটবেলাতেই ভালোবেসে বা না বেসে এটুকু পড়েছি। পদার্থের অণু ভাঙলে যেমন পরমাণু, আর পরমাণু ভাঙলে প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রন, তেমনই সঙ্গীত থেকে গান পাওয়ার পরও কিছু পাওয়ার বাকি থেকে যায় – একটি গানের ভিতরে যা যা পাওয়া যায় তা হল, গানের কথা, সুর আর গায়কী। পরমাণুর প্রোটন আর নিউট্রন মিলিয়ে হয় পরমাণুর কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াস, এক্ষেত্রে যা কিনা গানের কথা ও সুর; এগুলোই গানের সার। আর শেষ যেটা পড়ে থাকে, তা ইলেকট্রন। এর সঙ্গে তুলনীয় বিষয় অবশ্যই গায়কী, যা কিনা একটা নির্দিষ্ট গানে বদলে গেলে গানের বৈশিষ্ট্য বদলে বদলে যায়। একটা উদাহরণ দিই। সলিল চৌধুরির লেখা সুরে একটা খুব জনপ্রিয় গান ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’। আমরা বেশিরভাগ জনই শ্যামল মিত্রের গলায় গানটি শুনেছি। কিন্তু গানটি প্রথম তৈরি হয়েছিল কার জন্য, সেটা খুব বেশি জন হয়ত জানেন না। গানটি প্রথম ভাবা হয়েছিল তার জন্য, আমরা যাকে জর্জদা বলে চিনি, অর্থাৎ দেবব্রত বিশ্বাস। কিন্তু প্রথম রেকর্ড করেন শ্যামল মিত্র। পরবর্তীতে দেবব্রত বিশ্বাস আরো একবার করেছিলেন। দুজনের গায়কী দুরকম, ভালো-মন্দ বিচারের প্রশ্ন তাই আসে না, কিন্তু স্রেফ গায়কীর পার্থক্যে একই গান কেমন দুরকম হয়ে উঠতে পারে, তা বোঝানোর জন্য এর কথা বলা। দ্বিতীয়টি কারুর শোনা না থাকলে এই অধম লেখকের অনুরোধ রইল শোনার। সলিল চৌধুরির আরেকটি গানের কথাও বলি। উৎপলা সেনের কণ্ঠে শুনেছি অনেকেই—‘প্রান্তরের গান আমার/মেঠো সুরের গান আমার…’। এই গানটি তৈরি হয়েছিল প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের জন্য। রেকর্ডও হয়ে গেছিল। কিন্তু কণিকা বন্দোপাধ্যায় সলিল চৌধুরিকে চিঠিতে লিখলেন, “কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তোমার গান গাইলে আমাকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হবে। কাজেই আমাকে ক্ষমা কোরো ভাই।” অগত্যা রিলিজ হল না সে গান। তাই দুটি গানের গায়কীর পার্থক্য বোঝার উপায় এক্ষেত্রে নেই, যা বোঝা যেতে পারে তা অনুমান-নির্ভর।

গানের কথা, সুর আর গায়কী সব মিলিয়ে তাই একটি গান। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে অবশ্য, তা হল গানের অ্যারেঞ্জমেন্ট যা যন্ত্রানুষঙ্গ। সে বিষয়টা আপাতত থাক। এমনকি, সুর আর গায়কীর বিষয়েও আপাতত যাচ্ছি না। এই লেখার মূল বিষয় গানের কথা। না, ঠিক গানের কথা নয়, গানের কথার পরিবর্তন এ লেখার বিষয়। এ লেখার শিরোনাম তাই বদলানো নিয়ে, এখনকার একজন প্রখ্যাত কথাকার-সুরকার শ্রীসুদীপ বন্দোপাধ্যায়ের একটি গানের লাইন এ লেখার শিরোনামে আমার সম্বল। 

দেবব্রত বিশ্বাস বা কণিকা বন্দোপাধ্যায় প্রসঙ্গ যখন এল, প্রথমেই আসি রবীন্দ্রনাথের গানের প্রসঙ্গে। একজন প্রকৃত শিল্পী তার শিল্পকে বারবার কাটাছেঁড়া করেন, হয়ত বা সেটি সাধারণের সামনে আসার পরেও। এই খুঁতখুঁতানিই শিল্পীর লক্ষণ। রবীন্দ্রনাথের যে কোনো রচনার পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি দেখলেই তা বোঝা যাবে। রবীন্দ্রনাথের কেবল গানের কথাই যদি ধরি, কেবলমাত্র পূজা পর্যায়ের ৬১৭ টি গানের মধ্যে ২০১ টি গানে কম-বেশি কথা পরিবর্তনের উল্লেখ পাওয়া যায় সুভাষ চৌধুরীর ‘গীতবিতানের জগৎ’ বইটিতে। এই পরিবর্তন আবার প্রকাশিত হওয়ার পরে। দু-একটা উদাহরণ দিই। পূজা পর্যায়ের ৪ নম্বর গান ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’। আশ্বিন ১৩৩৮-এ গীতবিতানের প্রথম প্রকাশের সময় এ গানের বাণীতে ছিল ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’। ভাদ্র ১৩৪৫-এ পুনরায় প্রকাশের সময় তা হয় ‘কেমন করে গান করো হে গুণী’। কিন্তু  প্রচলিত গানে ‘তুমি কেমন করে গান করো’-ই আছে। পূজা ৩৩ : ‘কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে’। এ গানের শেষ লাইন গাওয়া হয় – ‘তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদয় আছে ছেয়ে’। কিন্তু গীতবিতানের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকাশে এই লাইনটি এরকম – ‘তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদয় আছে চেয়ে’। স্বরলিপিতে কিন্তু শব্দটি ‘ছেয়ে’, তাই ওটিই গাওয়া হয়। এ বিষয় যে রবীন্দ্রনাথ অনুমোদিত তা বুঝতে অসুবিধে নেই। কিংবা পূজা ১৯: ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার’ গানের সঞ্চারীর একটি লাইন ‘তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে/বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে’। আশ্বিন ১৩৩৮-এ প্রকাশিত গীতবিতানে শেষ লাইনটি ‘বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকাল বেলা যে’। আবার ভাদ্র ১৩৪৫ এর প্রকাশে দেখা যায় ‘তোমার সাথে গানের আমার দূরের খেলা যে/তাই বেদনায় বাঁশি বাজে সকল বেলা যে’। এরকম পরিবর্তন অনেক গানের ক্ষেত্রেই ঘটেছে।

রবীন্দ্রগানের কথা ছেড়ে এবার একটু আধুনিক গানের প্রসঙ্গে আসি। রবীন্দ্রগানে এই পরিবর্তন হয়ত সচেতন, কিন্তু সবসময় অন্যান্য ধরণের সব গানে এই বাণী পরিবর্তন সচেতনভাবে হয়নি। কখনো সচেতনভাবে হলেও তা বিশেষ উদ্দেশ্যে। একটা ছোট গল্প বলি। গল্পটা এমন একজনের যার নাম আজকের দিনে খুব কম সাধারণ মানুষই জানেন, তিনি সন্তোষ সেনগুপ্ত (১৯০৯-১৯৮৪)। মানুষটির জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে গেছে, অথচ কতজন মনে রেখেছেন তাঁকে? অথচ সেসময় তিনি কোন ধরণের গান না গেয়েছেন! বাংলা আধুনিক, গীত, ভজন, রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদী, নজরুলগীতি সব গেয়েছেন অনায়াস দক্ষতায়। কে. মল্লিকের রেকর্ড শুনে নিজে নিজে গান শেখার শুরু, তাও আবার অন্য বাড়িতে রেকর্ড শুনে। একবার তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘একদা তুমি প্রিয়ে’ গানটি শিখেছেন। প্রেম পর্যায়ের গান। নতুন শেখা গান যে বারবার গাইতে ইচ্ছে হয়, সেকথাটা সঙ্গীতশিল্পী মাত্রেই জানেন। শুধু সঙ্গীত নয়, কথাটা শিল্পের যে কোনো শাখায় সত্যি, ব্যাপারটা অনেকটা ওই কোলের ছেলের মত। তা যাই হোক, সন্তোষ সেনগুপ্তেরও এই নতুন শেখা গান বারবার গাইতে ইচ্ছে করছিল তখন। জলপাইগুড়ির ফণীন্দ্রদেব ইনস্টিটিউশনে ক্লাস টেনে পড়েন, পুরস্কার বিতরণী সভায় গান গাইতে হবে। নতুন শেখা গানটিই গাইবেন ভেবে ফেলেছেন। এদিকে মঞ্চে উঠে দেখেন সামনের সারিতে বসে আছেন বাবা ও অন্যান্য গুরুজনস্থানীয় মানুষজন। গুরুজনদের সামনে প্রেমের গান গাওয়া সেসময়ের ওই বয়সী একটি বাচ্চা ছেলের পক্ষে বেশ কঠিন ছিল। তাই তৎক্ষণাৎ তিনি প্রিয়ের জায়গায় প্রভু বসিয়ে ওই গানটিই গেয়ে দিলেন। কিন্তু হলে হবে কি! গানের বাণীর বাকি অংশেও তো প্রেমের কথা! সেসব তো অমন ‘স্টেজে মারা’ প্রায় অসম্ভব। তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে পরে তিনি লিখেছিলেন গানটি গাইতে তিনি কেমন সংকুচিত হয়ে পড়েছিলেন। সন্তোষ সেনগুপ্তের পরবর্তী জীবনের একটি ঘটনা বলি। শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুর করা প্রণব রায়ের কথায় ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে তারে কেন দিতে এলে ফুল’ একটি খুব প্রচলিত গান। প্রণব রায় এ গানের কথা শৈলেশ দত্তগুপ্তের কাছে দিয়ে এসেছিলেন সুর করার জন্য। গানটির কথায় ছিল ‘মিলনে যারে তুমি দাওনি মালা, বিরহে তারে কেন দিতে এলে ফুল’। শৈলেশ দত্তগুপ্ত কথায় কথায় সন্তোষ সেনগুপ্তকে জানালেন, এ গানে সুর করা হলে তাকেই গাইতে হবে। সন্তোষ সেনগুপ্ত উৎফুল্ল। সেদিনই সুর করে দেওয়ার জন্য বললেন শৈলেশ দত্তগুপ্তকে। সেদিনই দুপুরে দরবারি কানাড়ায় মুখড়াটি তৈরি হল। সন্তোষ সেনগুপ্ত শুনে বললেন ‘মিলন-বিরহ’ টা কেমন যেন হালকা হালকা লাগছে, তার বদলে কথাটা ‘জীবন-মরণ’ হলে ভালো হয়। তাই হল। আসলে সেসময় যত গান তৈরি হয়েছিল তাতে কথা, সুরের ক্ষেত্রে অনেকসময়ই যিনি গীতিকার বা সুরকার তাঁর সঙ্গে গায়কের মতামত বা সে গানের সঙ্গে যুক্ত নন এমন মানুষের মতামতও গুরুত্ব পেত। এই বিষয়টাকেই অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় তাঁর লেখায় বলেছেন co-operative impulse behind the creation। 

এই co-operative impulse behind the creation-এর উদাহরণ বহু গানে আছে। আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করি। মিল্টু ঘোষের কথায়, অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের সুরে শ্যামল মিত্রের একটি অসাধারণ গান ‘আহা একটি পারিজাত’। এ গানের গল্পটি পাওয়া যাবে অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের ‘গানের গল্প গল্পের গান’ বইতে। এ গানটি তৈরির আগে অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় মিল্টু ঘোষকে গানের কথা লিখে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু মিল্টু ঘোষ কিছুতেই সময়ে লিখে দিচ্ছিলেন না। এদিকে দেরি যে করছেন সে বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। একদিন সকালে হাজির হলেন অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়িতে। এসেই পরিবেশ হালকা করতে কচুরি আনার নিদান দিলেন। হারমোনিয়ামের পাশে বসে দেখেন ততক্ষণে অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় লিখে রেখেছেন গানের স্থায়ী। দুষ্টুমি হাসি হেসে বললেন, ‘ভালো হয়েছে, কাজ এগিয়ে রেখেছ।  তুমি কচুরিটা এনে ফেলো আমিও বাকিটা শেষ করে ফেলি’। অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় যথেষ্ট রেগেছিলেন, তাই বললেন বাকিটা স্থায়ীর মত ‘পোক্ত’ না হলে তিনি ‘নাকচ’ করে দেবেন। ফিরে দেখেন অন্তরা লেখা শেষ। গানটির অন্তরা এরকম – ‘এঁকেছি মনে যারে তিল তিল করে/ সে যে তিলোত্তমা এই অন্তরে’। অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের মনোভাবটা তাঁর কলমেই জানা যাক। তিনি লিখছেন, “মিল্টু ভালো করেই জানতো তিলোত্তমা, অনুরাধারা আমায় চিরদিনই কাবু করে এসেছে, -- মিল্টু আমায় সেই অস্ত্রে ঘায়েল করল।” এই উদাহরণ হয়ত ঠিক গানের বাণী পরিবর্তনের নয়, তবু একটি গানের দুই জায়গা দুজন মানুষ লিখলে নিশ্চয়ই কিছু পার্থক্য হয়; গানটা ঠিক যা হত, তার থেকে আলাদা হয় খানিক, সেইজন্যেই এই গানের কথা বলা। 


এবার সত্যি সত্যি পরিবর্তনের কথায় ফিরি। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের একটি গান ‘কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছ’, অনেকেই শুনেছেন। গানটি রঞ্জিত দে-র কথা, অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের সুরে। প্রথম লেখা হয় যখন, কথায় ছিল ‘কপালে কাঁচপোকা টিপ’। গানটি যখন নিতান্তই আঁতুড়ঘরে সেসময় একদিন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের শ্যামপুকুরের বাড়িতে বসে গানটির সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে। তখনি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ওই ‘কাঁচপোকা টিপ’ নিয়ে তার আপত্তি প্রকাশ করলেন। শেষমেশ কাঁচপোকা টিপ’ বদলে গিয়ে হল ‘সিঁদুর সিঁদুর টিপ’। এ তো গেল আলোচনা করে পরিবর্তনের কথা। ‘ঠুং ঠাং ঠুং ঠাং চুড়ির তালে’ গানটি তৈরির সময় প্রথম অন্তরায় শ্যামল গুপ্ত যে কথা লিখেছিলেন তা এইরকম ‘শাওন এল, মন বলে, কে যেন এল না/ মরমে মরমিয়া সাড়া কি পেল না’। অথচ মৃণাল চক্রবর্তীর গান শুনলে অন্তরার প্রথম লাইন একই হলেও দ্বিতীয় লাইনে যে কথাটা পাওয়া যাবে তা হল – ‘মরমে মরমিয়া গুমরিয়া কাঁদে’; প্রথম ও দ্বিতীয় লাইনে অন্ত্যমিল নেই। অথচ দ্বিতীয় অন্তরায় দেখা যাবে পরপর দুটি লাইনে অন্ত্যমিল। আসলে ঘটনাটা ছিল এইরকম – মৃণাল চক্রবর্তী টেস্ট রেকর্ডে গানটি গাইবার সময় কথা ভুল করেল, পরে শ্যামল গুপ্তের অনুমতিক্রমে সেই কথাটিই থেকে যায়। মৃণাল চক্রবর্তী নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে এই কথা বলেছেন। আবার ধরুন পিন্টু ভট্টাচার্যের গাওয়া সলিল চৌধুরির কথা-সুরে ‘আমি চলতে চলতে থেমে গেছি’। ১৯৭২ সালের গান। অথচ প্রথমবার রেকর্ড হয় ১৯৭১ সালে। গেয়েছিলেন সবিতা চৌধুরি। তার দ্বিতীয় অন্তরা যা ছিল, তা পিন্টু ভট্টাচার্যের গাওয়া ভার্সনের থেকে আলাদা। এই দ্বিতীয় অন্তরার পুরোনো কথা দিয়ে গানটি আরো পরে ১৯৮৮ সালে আবার রেকর্ড করেন লতা মঙ্গেশকর। এক্ষেত্রে একটা অবশ্যগ্রাহ্য যুক্তি হল পুরুষ ও মহিলা শিল্পীর ভার্সন তো আলাদা হবেই। কিংবা হিমাংশু দত্তের সুরে ‘তোমারি পথপানে চাহি’ গানটি। প্রথমবার রেকর্ড করেন মাধুরী সেনগুপ্ত। তখন কথা ছিল এরকম – ‘তোমারি পথপানে চাহি/আমারি পাখি গান গায়/শিশির নীরে অবগাহি/ কানন পথে ফুল ছায়’ আর সঞ্চারীতে ‘তোমারে নিয়েছিনু ভুলি’। অথচ পরে শ্যামল মিত্রের রেকর্ডে তা হল – ‘তোমারি পথপানে চাহি/আমারি পাখি গান গায়/শিশির নীরে অবগাহি/ কানন-পথ ফুলে ছায়’ আর সঞ্চারীতে ‘তোমারে গিয়েছিনু ভুলি’। এক্ষেত্রে পরিবর্তনের কারণ তেমন কিছু নয়। অনেক শিল্পীকে পরবর্তীতে গানটি গাইবার সময় ‘কানন কত ফুলে ছায়’ গাইতে শোনা যায়। কিন্তু দু:খের বিষয় এই কথাটির স্বপক্ষে কোনো প্রামাণ্য নথি নেই। শ্যামল মিত্রের রেকর্ডে ‘পথ’ শব্দের ‘থ’ শুনতে মাঝেমধ্যে ‘ত’ এর মত লাগে। সে কারণেই হয়ত শব্দটি অনেকে ভুল বোঝেন। আবার ধরুন, সলিল চৌধুরির ‘নাও গান ভরে, নাও প্রাণ ভরে’ গানটির কথা। প্রথমবার গানটি গাইলেন প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়, পরেরবার অন্তরা চৌধুরি। এক্ষেত্রেও দ্বিতীয় অন্তরাটি অন্তরা চৌধুরির রেকর্ডে আমূল বদলে গেল। এক্ষেত্রে একটা যুক্তি আছে, প্রথম ভার্সন ছিল পরিণতবয়স্ক শিল্পীর কণ্ঠে, আর দ্বিতীয়বারে শিশুশিল্পীর কণ্ঠে; তাই পরিবর্তন করা জরুরি ছিল। কিন্তু প্রথম রেকর্ডে প্রথম লাইনটি ছিল, ‘নাও গান ভরে, নাও প্রাণ ভরে সুরে যাই যেখানে প্রান্তর’, আর দ্বিতীয় রেকর্ডে ‘নাও গান ভরে, নাও প্রাণ ভরে চলো যাই যেখানে প্রান্তর’। এই পরিবর্তন তো বয়সের জন্য করা নয় নিশ্চয়ই। 

আসলে এই কথা পরিবর্তনের পিছনে মূল কারণ হল সেই শিল্পী-হৃদয়ের খুঁতখুঁতানি। বারবার যখন ফিরে যাওয়া হয় শিল্পের কাছে, বারবার বদলাতে ইচ্ছে করে। এই বহমানতাই আসলে শিল্প। শিল্পের বৈশিষ্ট্যই হল গতিশীলতা, থেমে গেলে শিল্প ও শিল্পীমন তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘‌সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপরে সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়।’‌


তথ্যঋণ 
১। গীতবিতানের জগৎ, সুভাষ চৌধুরী।
২। আমার সংগীত ও আনুষঙ্গিক জীবন, সন্তোষ সেনগুপ্ত।
৩। সুরের পথের হাওয়ায়, স্বপন সোম।
৪। গানের গল্প গল্পের গান, অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়।
৫। সপ্তর্ষি ঘটকের সঙ্গে আলোচনা।

Comments

পাঠকের পছন্দ