মৌপিয়া মুখার্জী


বাংলা গান ও কবিতার আকাশের ধ্রুবতারা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “আমাদের ভাবপ্রকাশের দুটি উপকরণ আছে – কথা ও সুর। কবিতায় আমরা কথার ভাষাকে প্রাধান্য দিই ও সংগীতে সুরের ভাষাকে প্রাধান্য দিই। কবিতা যেমন ভাবের ভাষা, সংগীতও তেমন ভাবের ভাষা।” কবিতা ও গান আমাদের ভাব প্রকাশের দুই ভিন্ন অথচ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত মাধ্যম। প্রধানতঃ কবিতার ভিত্তি হল শব্দ বা কথা আর গানের ভিত্তি হল সুর। কবিতার ক্ষেত্রে যা ছন্দ, গানের ক্ষেত্রে তা লয়। কবিতার চলন রৈখিক – সে যাত্রা শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছয়, আর ফেরেনা, কিন্তু কণ্ঠসংগীতের চলন বৃত্তাকার – আরোহ, অবরোহ, তান, গমক, মীড়ের জটিল আবর্তের মধ্য দিয়ে সে বারবার উৎসমুখে ফিরে আসে। কবিতা লেখা বা পাঠ করার সময় আমরা শব্দের অর্থকে গুরুত্ব দিই। গানের ক্ষেত্রে কথা ও সুরের সমন্বয়ে যে ভাবটি ফুটে ওঠে, তার রসাস্বাদন করে মুগ্ধ হন শ্রোতা। আবার একথাও অনস্বীকার্য যে, একটি কবিতা তখনই কালোত্তীর্ণ হয় যখন তার শব্দচয়ন, মাত্রা, ছন্দ ইত্যাদি টেকনিক্যাল বিষয়গুলির সাথে কবির গভীর মানবিক অনুভূতির সুরটি বাঁধা হয়। বিখ্যাত আমেরিকান কবি Ezra Pound তাঁর “The ABC of Reading” গ্রন্থে লিখেছেন, “Poetry begins to atrophy when it gets too far from music” । পক্ষান্তরে, কণ্ঠসংগীতের ক্ষেত্রে সুরের পাশাপাশি গানের বাণীর তাৎপর্যও অপরিসীম। তাই কবিতা ও গান কখনই সমান্তরাল নয়, এরা মানুষের ভাবজগতের দুটি শাখানদী যারা মিলিত হয়ে এক অনতিক্রম্য স্রোতস্বিনীতে রূপান্তরিত হয়।
নৃবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা অনেকেই এই মত পোষণ করেন যে, আদিম মানুষ কথা বলতে শেখার আগে সুর সৃষ্টি করতে শিখেছে। বিবর্তনের পথ ধরে মানুষ যখন ভাষা সৃষ্টি করেছে, কথা বলতে শিখেছে, তখন কথার সাথে সুর, তাল, লয় ও ভাবের মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছে গান বা কণ্ঠসংগীত। সংগীতের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও পরম্পরার দেশ ভারতবর্ষের শাস্ত্র ও পুরাণে সংগীতের উৎপত্তি সম্পর্কে যে ধারণাগুলি প্রচলিত, তার মধ্যে একটি হল বিভিন্ন পশুপাখির ডাক থেকে সাতসুরের সৃষ্টি। এই মতানুসারে, সুরসপ্তকের সা বা ষড়জের উৎপত্তি ময়ূরের ডাক থেকে, বৃষভ (মতান্তরে চাতক) এর ডাক থেকে রে বা ঋষভ, ছাগলের ডাক থেকে গা বা গান্ধার, সারসের ডাক থেকে মা বা মধ্যম, কোকিলের ডাক থেকে পা বা পঞ্চম, ঘোড়ার হ্রেস্বা থেকে ( মতান্তরে ভেকের ডাক থেকে) ধা বা ধৈবত ও হাতির ডাক থেকে নিষাদ বা নি স্বরের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক সংগীত সৃষ্টির ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদানের স্বাক্ষর রেখেছে। নদীমাতৃক বঙ্গভূমির সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা প্রকৃতির প্রভাবে বাঙালি স্বভাবকবি। তাই ভারতীয় মার্গসংগীতের জটিল শাখা-প্রশাখা, বিভিন্ন ঘরানা, গায়কী, গুরুশিষ্য পরম্পরার ইতিহাস থেকে বাংলা গানের ইতিহাস অনেকখানি স্বতন্ত্র। 
কবি অতুলপ্রসাদ সেন লিখেছিলেন, “মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা
কী যাদু বাংলাগানে, গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।”

যথার্থই বাংলার মানুষের জীবন শৈলীতে, মাঠের আদিগন্ত সবুজে, ঘরের দাওয়ার নিশ্চিন্ততায়, নদীর বহমানতায়, পূজা-পার্বণের আনন্দে গান এক অবিচ্ছেদ্য অনুরণন। তাই খেয়াল, ধ্রুপদ, ধামার, ঠুংরি যে সময় বাংলার বাবু কালচারের অন্যতম অঙ্গ, তখন বাংলার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ ছিল সারি, জারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, টুসু, ভাদু, বাউল, ঝুমুর, মুর্শিদি, পাঁচালি, কবিগান প্রভৃতি।    
ইতিহাস বলে, বাংলা গান প্রথম থেকেই কাব্যগীতি। চর্যাগীতি, গীতগোবিন্দ, কীর্তন, পদাবলীসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, রামায়ণগান, রামপ্রসাদী, ঢপকীর্তন, কবিগান, খেউড়, তরজা, কথকতা সবই সুরারোপিত কাব্য। এই গীতিকাব্যগুলির মধ্যে কবিগান, খেউড় ইত্যাদি যে সবই খুব উচ্চমার্গের সাহিত্যরস সমৃদ্ধ ছিল তা বলা যায়না। বৈষ্ণব যুগের পর রামপ্রসাদী শ্যামাসংগীত, নিধুবাবুর টপ্পা, শ্রীধর কথক, কালী মির্জা, কমলাকান্ত, দাশরথি রায়, গোপাল উড়ে প্রমুখের হাত ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও কাজী নজরুল ইসলাম এই পঞ্চ গীতিকবির যুগে বাংলা গান দেশ তথা সমগ্র বিশ্বের সংগীত জগতে এক স্বাতন্ত্র ও বিশিষ্টতায় উন্নীত হয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা সংগীত উদ্যানের এক বিশাল মহীরুহ। তিনি মার্গ সংগীতের সাথে লোকগান, প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের ধারার মিলন ঘটিয়ে বাংলা গানকে নতুন রূপে সাজিয়ে অনন্যা করে তুললেন। তিনি তাঁর অধিকাংশ গানে ধ্রুপদের চারটি তুক – স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ এর ব্যবহার করে আধুনিক গানের কাঠামোটি গড়ে দিলেন।    
নজরুল পরবর্তী যুগে আধুনিক বাংলা গানের আঙিনায় এক অভিনবত্বের সূচনা হল। এর আগে পর্যন্ত গীতিকার ও সুরকার ছিলেন একই ব্যক্তি। কিন্তু এই সময় থেকে সে ধারা বদলে গেল। একজন  গীতিকারের রচিত গীতিকাব্যে সুর করলেন অন্যজন। অর্থাৎ, গীতিকার ও সুরকার দুই ভিন্ন ব্যক্তি। 
অর্থাৎ, এক ব্যক্তির কবিতায় সুরারোপ করে অন্য ব্যক্তি তা গাইতে পারলেন এরপর থেকে।
নচিকেতা ঘোষ কথার ওপর সুর দিতেন, সুধীন দাশগুপ্ত সুর তৈরী করে কথায় বসাতেন। সুধীন দাশগুপ্তের সুরে আশা ভোঁসলের গাওয়া "কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে" গানটিতে আগে সুর করার পর পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় কথা বসান।
১) জীবনানন্দ দাশের লেখা "হায় চিল" কাব্যকে গানে রূপ দিয়েছিলেন অনুপ ঘোষাল।
২) প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা "সাগর থেকে ফেরা"-এ সুরারোপ করেন সুধীন দাশগুপ্ত এবং গানটি গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
৩) হেমেন্দ্রকুমার রায়ের কবিতা "অন্ধকারের অন্তরেতে"- কে গানে রূপ দিয়েছেন কৃষ্ণচন্দ্র দে।
৪) সজনীকান্ত দাশের কবিতা "জাগে নবভারতের" কে গানে রূপ দিয়েছেন সুকৃতি সেন জনতা।
৫) অন্নদাশঙ্কর রায় রচিত "তেলের শিশি ভাঙলো বলে" এর সুরকার সলিল চৌধুরী।
৬) শৈলেন রায়ের কবিতা "কত কথা প্রাণে" কে সুর দিয়েছেন অনুপম ঘটক জাগে'।
৭) সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের "ছোটদের রামায়ন"-এ সুরারোপ করেন সুধীন দাশগুপ্ত।
৮) সুকান্ত ভট্টাচার্যের "রাণার" ও "অবাক পৃথিবী"-কে সংগীতে রূপ দেন সলিল চৌধুরী।
৯) কুমুদরঞ্জন মল্লিকের "ওরে মাঝি, তরী হেথা বাঁধবো নাকো"-কে গানে রূপ দেন ইন্দুবালা দেবী।
১০) বিমল ঘোষ রচিত "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" -কে গীতিরূপ দিলেন সলিল চৌধুরী।
১১) সুকুমার রায় রচিত "বাবুরাম সাপুড়ে" কবিতায় সুর দিয়েছেন অরুণ বসু।
১২) যতীন্দ্রমোহন বাগচি রচিত "বাঁশবাগানের মাথার ওপর"-এর‌ সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত।
১৩) তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের "মধুর‌ মধুর বংশী বাজে"-এর সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত।
১৪) মাইকেল‌ মধুসূদন দত্তের "রেখো মা দাসেরে মনে" কাব্যের সুরকার সলিল চৌধুরী‌।
১৫) সত্যেন্সনাথ দত্তের "পাল্কির গান"-এর সুরকার সলিল চৌধুরী ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৬) জীবনানন্দ দাশের "আবার আসিব ফিরে"-কবিতার সুরকার অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়।

পরবর্তীতেও বেশ কিছু কবিতায় সুরারোপ করে তাকে গানে‌ রূপ দেওয়া হয়েছে। যেমন,জয় গোস্বামী রচিত "মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়" কবিতাটি গান হিসেবে শুনি লোপামুদ্রা মিত্রের কন্ঠে।সমীর চ্যাটার্জীর সুরে লোপামুদ্রা মিত্রের কন্ঠে শুনি শুভ দাশগুপ্তের কবিতা "মেঝেতে গর্ত ছিল"। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের "বাঁদিকের বুক পকেটটা"-কাব্যে সুর দেন সমীর চ্যাটার্জী,গায়ক লোপামুদ্রা মিত্র। কবীর সুমনের কথা ও সুরে সৃষ্টি হয়েছে "তুমি শুনো না আমার কথা" ও "নেচে ওঠ নিথর সময়"।
এমন‌ করেই কাব্য ও সংগীত মিলেমিশে একাকার হয়ে প্রবেশ করেছে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, আমাদের চেতনায়। তবে একথা ঠিক-ই সব কবিতাকে গানে রূপ দেওয়া যায় না,কারণ সব গীতিকাব্যে তেমন‌ সাহিত্যগুণ থাকে না।
সুধীন দাশগুপ্তের কথা ও সুরে মান্না দে-র  গাওয়া "চার দেওয়ালের মধ্যে নানা দৃশ্যকে" গানটি কাব্য হিসেবেও উৎকৃষ্ট।
আবার, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় রচিত "এ কোন‌ সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার" গানটি যদি সুরারোপিত নাও হত,কেবল কবিতা হিসেবেই সুখপাঠ্য। পরবর্তীকালে সুমন চট্টোপাধ্যায়(কবীর সুমন), শিলাজিৎ মজুমদার, অনুপম রায় রচিত গীতিকাব্যগুলি সঙ্গীতজগতের পাশাপাশি সাহিত্যজগৎকেও সমৃদ্ধ করে। শহীদ কাদরীর লেখা কবিতাকে গানে রূপ দেন কবির সুমন। গানটি ছিল-"তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা"।
তবে, স্বর্ণযুগের অনেক গান কিন্তু কেবলমাত্র সুরকারের দক্ষতাতেই সমৃদ্ধ, কবিতা হিসেবে দেখলে এগুলি অত্যন্ত দূর্বল। যেমন,মান্না দের কন্ঠে "সুন্দরী গো দোহাই দোহাই মান কোরো না" গানটি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত। এটি সুর ও গায়কির গুণে উত্তীর্ণ হলেও এর বাণীতে কাব্যগুণ পাওয়া যায় না।

দূরদর্শনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সলিল চৌধুরী বলেন, "কবিতার কাব্যগুণ অক্ষুণ্ণ রেখে সুর সংযোজন করে সঙ্গীত সৃষ্টি করা উচিত"। যখন তিনি "পাল্কির গান"-এ সুর করেন, তখন পাল্কির গতির পরিবর্তন বোঝাতে সরোজ পরিবর্তন(tonic change) এবং তালফেরতা ব্যবহার করেছেন বেহারাদের ক্লান্তি বোঝাতে। "রাণার" কবিতায় সুরারোপ করে‌ তাকে গানের‌ রূপের ক্ষেত্রে প্রচলিত স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ-এই ফর্মটি ভাঙতে হয়েছে কারণ কবিতার চলনটি রৈখিক।
একটি সাক্ষাৎকারে সলিল চৌধুরী বাংলা আধুনিক গানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলেছিলেন, "জীবনমুখীতাই বাংলা আধুনিক গানের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সিনেমার গান যখন থেকে তৈরী হতে শুরু করলো তখন গীতিকার ও সুরকার দুটি ভিন্ন কম্পার্টমেন্ট হয়ে গেল। এইসময়ের পরেও অনেক কালজয়ী গান সৃষ্টি হলো ঠিক-ই, কিন্তু আমাদের কবিকুল গান রচনা থেকে সরে গেলেন। যার ফলে‌ বাংলা গানের‌ সাহিত্যমূল্য কমে গেল। "তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে‌ বাংলার কবিকুল, যাদের "মকশো" করা লেখার হাত তারা যদি গান রচনার কাজে এগিয়ে না‌ আসেন তবে‌ বাংলা আধুনিক গানের‌ ভবিষ্যৎ ভালো‌ হবে না।

গান মানুষের কাছে অনেক বেশিমাত্রায় পৌঁছোয় কবিতা অপেক্ষা। তাই গানের মাধ্যমে আমরা বহু কবিতাকেও মানুষের অন্তরে পৌঁছে দিতে পারি।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
১)অজন্তা জানা,গবেষক,সঙ্গীতভবন,বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়-এর প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র।
২)বাংলা কাব্যসঙ্গীতের ধারা-রবীন্দ্রনাথ থেকে বাংলা ব্যান্ড।
৩)"কথায় ও সুরে"-সলিল চৌধুরীর সাক্ষাৎকার।

Comments

পাঠকের পছন্দ