সাক্ষাৎকার : গৌরব চট্টোপাধ্যায়



গৌরব (গাবু) চ্যাটার্জি। নামটা সংগীত-শিল্পী মহলের এক অত্যন্ত পরিচিত নাম। তিনি হলেন একাধারে একজন ড্রামার ও কম্পোজার এবং 'লক্ষ্মীছাড়া' ব্যান্ডটির একজন প্রধান ফাউন্ডার মেম্বার। তিনি 'মহীনের ঘোড়াগুলি'-খ্যাত গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সুযোগ্য পুত্র।
২০১২ থেকে ইন্দো-জ্যাজ ব্যান্ড 'কেন্দ্রক'-এর সদস্য হলেন গৌরব চট্টোপাধ্যায়। বাংলা টলিউডের নানান চলচ্চিত্রের মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেন গৌরব, এছাড়াও অন্যান্য মিউজিক ডিরেক্টরদের হয়ে ড্রাম বাজিয়ে থাকেন নানান চলচ্চিত্র ও মিউজিক অ্যালবামে। তিনি ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান ব্যান্ড 'দি থ্রি সি'স'-এর একজন সক্রিয় সদস্য এবং মালেসিয়ার "বিট গো'স বাখ" প্রজেক্টের এক অন্যতম অংশ। গৌরব চট্টোপাধ্যায় এযাবৎ বিক্রম ঘোষ, পূর্বায়ন চ্যাটার্জি, পণ্ডিত দেবাশিস ভট্টাচার্য, শুভেন চ্যাটার্জি, কলা রামনাথ প্রমূখদের সঙ্গে কাজ করেছেন বহুবার!
'পান্থজন'-এর 'গান' সংখ্যার জন্য গাবু চ্যাটার্জির সাক্ষাৎকার নিলেন এ সময়ের একজন প্রতিভাবান তরুণ মিউজিশিয়ান প্রাজ্ঞ দত্ত। প্রাজ্ঞ দত্তএকজন  পুরস্কার প্রাপ্ত সংগীতশিল্পী, ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং মার্শাল আর্টিস্ট| এই তিনটি বিভাগেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রকল্পে কাজ করেছেন।



পান্থজন :  সংগীত পরিবারে বড় হওয়া আপনি কখন সংগীত রচনা/পরিচালনা শুরু করেছেন-- এবং আপনার এ ক্ষেত্রে প্রথম আদর্শ কী বা কে ছিল?

গৌরব : আসলে প্রডিউসিং মিউজিক কীভাবে , ছোটবেলায় আমার একটা এমনিই পেরকাশন এর প্রতি ন্যাক ছিল। আমি নাকি নানা জিনিসপত্র , ওই টিন বাজাতাম। ছোটবেলা তে যদি না ঘুমাতাম, আমার মাথায় কেউ হালকা করে বাজিয়ে দিলে , আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। এসব গল্প শুনেছি। এরমই পার্কাশন এর প্রতি একটা ভালোবাসা দেখে, ছোটবেলায় আমি আমার ফার্স্ট কিট পাই। আর যখন আমার চার বছর বয়স তখন আমি প্রথম পারফর্ম করি। শিশির মঞ্চতে। যেখানে বাবার একটা পারফরম্যান্স ছিল। সেখানেই আমি প্রথম পারফর্ম করি, ছোট্ট সেকশন বেশ মজার ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি কম্পোজ করার চেষ্টা করতাম। গান লেখার বা গান বানানোর চেষ্টা করতাম।কিন্তু পরবর্তীতে লক্ষ্মীছাড়ার সাথে সেটা সিরিয়াস জায়গায় পৌঁছায়। ওই ঠিকভাবে ২০০০ সালের শেষ দিকে গান কম্পোজ করি প্রপার ভাবে। ছোটবেলাতেও কম্পোজ করতাম, তবে সেগুলো নিয়ে সেভাবে কাজ করিনি। কিন্তু ওই স্কুল এর শেষ র দিক থেকে কলেজের... ওই ফার্স্ট-ইয়ার-- এই সময়ে ব্যাপারটা গ্রো করে। ওই ১১-১২ ক্লাস থেকে ব্যাপারটা সিরিয়াস জায়গায় পৌঁছায়। ছোটবেলাতেও করেছি, ওই মজা করে, কিন্তু ওই কলেজ টাইম থেকে ব্যাপারটা সিরিয়াস জায়গায় পৌঁছায়। প্রপার শো করা, মানুষের সামনে , অভিজ্ঞ শিল্পীদের সাথে এই সময়টাতেই ব্যাপারটা শুরু হয়। ছোটবেলার প্রেরণা বলতে , বাবার নাম বলতেই হবে। ওনার ভূমিকা সব থেকে বেশি। তারপর আমার দাদা নীল মুখার্জী গিটার বাদক 'ক্রসইন্ডস' এর, অনেকদিন ছিল। নীলদার... মহিনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত বাংলা গানের যে অ্যালবামগুলো বেরিয়েছিল, নব্বই এর শুরুতে, তার প্রথম তিনটেই নীলদার এরেঞ্জমেন্ট। বাবা, নীল দা , তাছাড়া প্রচুর  ব্যান্ড এর গান শুনেছি, ইন্টারন্যাশনাল আর্টিস্টদের গান শুনতাম। বিটলস হোক বা স্টিং হোক বা পুলিশ। সেখান থেকেই আসতে আসতে গ্রো করা শুরু করে। রক-ব্যান্ড এর গান... হ্যাঁ শুনেই বড়ো হয়েছি। ওই আশির দশকের শুরুতে, গ্রংজ মুভমেন্ট টা উইটনেস করা , বা মিউজিক চ্যানেলগুলো ইন্ডিয়া তে আসায় , ওই লাইভ পারফরম্যান্স গুলো দেখতে পারি, সেটা অনেকটাই সাহায্য করে।

পান্থজন : বেশিরভাগ শিল্পীদের ক্ষেত্রে, মৌলিক শিক্ষা প্রথমে শেখার একটি পর্যায়ে এবং প্রায়ই অন্যকে অনুকরণ করেই হয়। আপনার জন্য এটা কেমন ছিল?  শিল্পী হিসাবে আপনার নিজের বিকাশ এবং নিজের কন্ঠকে আপনি কীভাবে বর্ণনা করবেন?

গৌরব :  আসলে একজন আর্টিস্ট হিসাবে সব কিছুই আমি লিখে রাখতাম , যা আমি শিখতাম। শুরু থেকেই ড্রুমকিট বানানো , ইনস্ট্রুমেন্ট দেখা আমার শেখার অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে দেয়। পুরো প্রসেসটাই। প্রথম দিন থেকেই শেখাটা খুব দরকার। আমি এখনো প্রসেস-এ আছি, এখনো শিখছি , চেষ্টা করছি সর্বদা। আমি সর্বদা চেষ্টা করি...  আরো ভালো করার। এছাড়া আমি যাদের থেকে প্রেরণা পেয়েছি, তাদের থেকেই অনেকটা নিয়েছি। কিন্তু তাও চেষ্টা করেছি অরিজিনালিটি বা নিজস্বতা বজায় রাখার। আমার কাছে এ বিষয়টা খুব প্রাধান্য পেয়েছে। এটা একটা জার্নি। পুরোটাই একটা প্রসেস। নিজেকে এক্সপ্লোর করার। চেষ্টা করি আরো জ্ঞান বাড়ানোর।

পান্থজন : শুরুর দিকে আপনার সঙ্গীত রচনা  প্রযোজনায় চ্যালেঞ্জগুলি কী ছিল এবং সময়ের সাথে সাথে কীভাবে সেগুলো পরিবর্তিত হয়েছে?

গৌরব : আমার মনে হয় , যখনই সুর কম্পোজ করার বা প্রোডাকশন করার কথা আসে, অনেক মিউজিসিয়ান-এর হেল্প নিয়েছি, খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু এখন চেষ্টা করছি, নিজের বাড়িতে বসে, নিজের সেটাপ-এ বসে কাজ করার । অবশ্যই আমি ওনাদের সাথে কাজ করবো, ওনাদের খুব শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তাও নিজেকে একটু আত্মনির্ভরশীল করার জন্য , নিজে থেকে কিছু করার চেষ্টা করছি। আর যখনই কম্পোজিশন এর কথা আসে, তখন নিজের চিন্তাভাবনা বা অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।  যখন আমি নিজের কাজ করছি, বা নিজের সুর বানানোর চেষ্টা করছি-- এটাই একটা জার্নি। ধরুন ২০০৫-২০১০-এ আমি যা বানাতাম বা ভাবতাম , সেটা এখন পাল্টেছে। চিন্তা ভাবনা , অভিজ্ঞতা থেকেই পাল্টেছে। এটা সর্বদা সময়ের সাথে বদলাতে বা পাল্টাতে থাকে।  এই অভিজ্ঞতাগুলোই একটা জার্নি।

পান্থজন : আপনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি বাংলা স্বতন্ত্র মিউজিকের পুরো বিবর্তনটি দেখেছেন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে আপনার কী মতামত রয়েছে?

গৌরব : এখন বিষয় টা অনেকটাই প্রগতিশীল, অনেক নতুন ব্যান্ড-আর্টিস্ট , অনেক ভালো কাজ হচ্ছে  এখানে। কিন্তু তাও আমাদের অনেকটা সাপোর্ট এর দরকার টিভি বা রেডিও থেকে। বা মিডিয়ার থেকেও। আমি নন-ফিল্ম মিউজিক-এর কথাই বলছি। সবাই এখন সোশাল নেটওয়ার্ক-এ আছে , সবার নিজস্ব ফলোয়ার আছে, অবশ্যই এটা একটা পজিটিভ দিক।  অনেক বেশি সুযোগ আসছে, সেটা খুব ভালো। এখন সবাই নিজের মতো সুর বানাচ্ছে , আর আপলোড করছে। সো... মানুষ অনেকটা ভালোভাবে এর কাছে পৌঁছাতে পারছে। যেভাবে আমরা শুরু করেছিলাম তখন ক্যাসেট ছিল, তারপর সিডি । এখন ব্যাপারটা অনেকটা আলাদা। আমার মনে হয় এখন অনেক আর্টিস্ট আছে শহরে, আমরা অনেক ফেস্টিভ্যাল করতে পারি । আশাকরি এরা এইভাবে কাজ করতে থাকবে, আরো ভালো হবে ভবিষ্যতে।

পান্থজন :  সঙ্গীত রচনার আপনার পছন্দসই প্রক্রিয়াটি... এমন কোনও টুকরো বা অ্যালবামের ভিত্তিতে বর্ণনা করতে পারেন প্লিজ?  আপনার সেই সব ধারণাগুলি কোথা থেকে আসে, আপনি কী দিয়ে শুরু করেন এবং কীভাবে আপনি এই ধারণাগুলি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কী বিষয়ে জোর দেন?

গৌরব : ক্রিয়েটিভ প্রসেস নিয়ে কথা বলতে গেলে , বলতে হয় যখনই কেউ একটা সুর বানায় , সমস্ত ব্যান্ড একসাথে বসে কাজ করে সুর বা গানের ওপর। অনির্বাণ, যে লেখে আমাদের সব গান , আমরা সবাই মিলে জ্যাম করতাম।  সেটা সত্যি দারুন অভিজ্ঞতা।। অনির্বাণ মেলোডি-র সাথে তাল মিলিয়ে লিখতো।। এইভাবেই লক্ষ্মীছাড়াতে কাজ করতাম সবাই মিলে। এখন অনেকটা পাল্টে গেছে ,এখন আগে আমরা সুর বানিয়ে মেইল বা কোনো অ্যাপ র মাধ্যমে পাঠিয়ে দিই আলোচনা করতে। তারপর আমরা দেখা করে জ্যাম করে ব্যাপারটা জমাই , রেডি করি। এটাও খুব ভালো প্রসেস। কিন্তু শুরুর ওই অভিজ্ঞতাটা এখনো আমার কাছে খুব স্পেশাল ।

পান্থজন : এবং অবশেষে একটাই প্রশ্ন, যাঁরা স্বপ্ন দেখেন তাঁদের নিজস্ব মূল সংগীত তৈরি করার, তাঁদের উদ্দেশ্যে আপনার কোন বার্তা দিতে চান?

গৌরব : আমার মনে হয় মিউজিক বানিয়ে যেতে হবে ,সুর সৃষ্টি করে যেতে হবে। শুধু মাথায় রেখো , যে কারোর ওপর অর্থনেতিক ভাবে যেন নির্ভর না করতে হয় শুরুর দিকে। যেটা তোমার করা উচিত-- যদি তুমি ফুলটাইমও কাজ করো , নিজের অরিজিনাল সুরকে সাপোর্ট করা উচিত। সেটা তোমার ক্রিয়াটিভ সত্তাকে পরিত্তৃপ্ত করবে । রেজাল্ট এর কথা না ভেবে , করে যাওয়া উচিত। নিজের কাজ টা করে যাওয়া উচিত।  নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে কাজ করে যাওয়া উচিত।

পান্থজন : অনেক অনেক ধন্যবাদ গাবুদা। ভালো থাকবেন খুব।

গৌরব : তোমরাও ভালো থেকো। আর 'পান্থজন'-এর জন্য রইল আমার শুভকামনা।   

Comments

পাঠকের পছন্দ