শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


মার্কিন দেশজুড়ে মানুষ নেমে এসেছে রাস্তায়। বলছে, কৃষ্ণাঙ্গ জীবনেরও মূল্য আছে। এবং এই আওয়াজ উঠছে যে মানুষের কাতার থেকে সেখানে দলে দলে যোগ দিচ্ছেন সাদা চামড়ার মানুষ, বাদামী, আদিবাসী, এশীয়- সবাই। সামাজিক গণমাধ্যমে একটি ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি শহরে একদল সাদা চামড়ার মানুষ হাঁটুমুড়ে বসে আছেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের দিকে। সমবেত কন্ঠে ক্ষমাপ্রার্থনা করছেন, শত শত বছর ধরে তাঁদেরই র্প্বূপুরুষদের তরফ থেকে ওই কালো মানুষদের উপর নামিয়ে আনা সীমাহীন অত্যাচার আর বৈষম্যের জন্যে। যাঁরা ক্ষমা চাইছেন, তাঁদের চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছে জল। যাঁদের কাছে ক্ষমা চাইছেন, আকুল কান্নায় ভরে যাচ্ছে তাঁদেরও চোখ মুখ। আমরা যারা ভারতের মানুষ আমরা বিস্মিত। আমাদের লজ্জায় অধোবদন। আমার দেশেও একই ভাবে যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিত অত্যাচারিত হয়েছে দলিত জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুরা। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় পেয়ে যে অত্যাচার আরো তীব্র ও নগ্ন হয়েছে। আমাদের শিক্ষিত সমাজ শুধু নীরব নয়। বরং একটি বড় অংশ এই সহিংস বৈষম্যের সোচ্চার সমর্থক। লজ্জা ও বিস্ময় নিয়ে যখন আমরা গণমাধ্যমের পর্দায় চোখ রাখছি, ঠিক তখনই সামাজিক গণমাধ্যমে একটি গান ছড়িয়ে পড়ল। ‘একটা কালো মানুষ মরলো বলে আমেরিকায় আগুন জ্বলে, আমরা কেমন ভেজা বারুদ জ্বলতে পারি না’। লিখেছেন, সুর করেছেন, গেয়েছেন কাজী কামাল নাসের। আমাদের সকলের মনে যে কথাটি ঘুরছিল লজ্জায় ও বিস্ময়ে, কাজীদার গান যেন সেই কথাটাই বলে দিল। এর একটু আগেই আমরা ফেসবুকে টুইটারে ওয়াটসআপে লিখছিলাম, কবে আমাদের দেশে ‘মুসলিম জীবনেরও মূল্য আছে, দলিত জীবনেরও মূল্য আছে’ ধ্বনি তুলে রাজপথে নেমে আসবে মানুষ। কবে এ দেশের সংখ্যালঘু ও দলিত সমাজের সামনে ঠিক এভাবে হাঁটু মুড়ে বসে আখলাক তবরেজ নাজিব রোহিতদের মৃত্যুর জন্যে ক্ষমা চাইবে এদেশের উচ্চমন্য উচ্চবর্ণের লোকেরা? আমাদের সব চাওয়া এবং না-পারা যেন গানে ব্যক্ত হয়ে গেছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল গানটি সামাজিক গণমাধ্যমেও আনাচে কানাচে। গানের অন্তিম পংক্তিতে এসে কথাটা যেন বুঝেও বুঝতে পারছিলাম না। কান পেতে শুনলাম। কেমন খটকা লাগল। কিছু বললাম না, কারণ এই সামান্য খটকার চেয়ে অনেক বৃহত্তর কথা বলে দিয়েছে গানটা। পরদিন সন্ধ্যাবেলা ফোন এলো ঢাকা থেকে আরিফ নূরের। আরিফ বাংলাদেশের অগ্রণী প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী। শাহবাগ আন্দোলনে সক্রিয়তার জন্যে মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাত নেমে এসেছিল তার মাথায়। সে মুষ্টিমেয় হাতগোনা মানুষের একজন যে মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাত পেয়েও বেঁচে ফিরেছে। অস্ত্র নির্বাচন ও আক্রমণের পদ্ধতিতে বাংলাদেশে মৌলবাদীরা এতটাই দক্ষ যে খুব কম সময়ের সামান্য কয়েকটি ঘা নামিয়ে এনেই তারা নিশানা করা মানুষটির মৃত্যু সুনিশ্চিত করতে পারে। আক্রান্ত মানুষেরা বাঁচতে পারে না দুটো কারণে মূলত। প্রথমত, ঘটনার আকস্মিকতায় কোনো কিছু বোঝার আগেই আক্রমণকারীরা দ্রুততার সাথে তাদের কাজ সমাধা করে ফেলে। দ্বিতীয়ত, চাপাতি হাতে মৌলবাদীদের দেখলে অন্য পথচারীরা আক্রান্ত মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার পরিবর্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত নিজেদের সরিয়ে নেয়।  আরিফ বেঁচে গিয়েছিলও দুটো কারণে। এক, শাহবাগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে ও সবসময়েই সশস্ত্র মৌলবাদীদের সম্ভাব্য আক্রমণ নিয়ে মনে মনে সতর্ক থাকত। ফলে ওকে যখন আক্রমণকারীরা চাপাতির ঘা দিচ্ছে, তখন সেও সমানে তাদেরকে প্রতিআক্রমণ করে গেছে। দ্বিতীয় কারণটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যক্ষেত্রে যেমন উপস্থিত অন্য পথচারীরা সরে পড়ে, আরিফের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে নি। আরিফ যখন আক্রান্ত হয়, তখন অদূরেই ছিল কিছু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যাঁরা ছুটে আসে আরিফকে বাঁচাতে। এই মানুষগুলি সাহসী প্রতিরোধের মুখে আক্রমণকারীরা তাদের অর্পিত দায়িত্ব অসমাপ্ত করেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আরিফের ফোনটা এসেছিল হয়ত ওর এই পূর্ব অভিজ্ঞতার জন্যে। কাজীদার গানের শেষ পংক্তিতে ছিল ‘আর কতকাল থাকব বসে ক্লীবের মত এই আপোষে/ মরার আগে একবারও কি জ্বলতে পারি না’। আরিফ বলল, দাদা, গানের শেষ পংক্তিটা ঠিক যেন কি? আমি বললাম, বুঝতে পেরেছি। তুমি ক্লীব শব্দটার কথা বলছ তো? আরিফ বলল, হ্যাঁ। ওটা ক্লীবই তো? দাদা, সেক্ষেত্রে এই শব্দটা কি গানটার মূল আদর্শের সাথে বেমানান হয়ে গেল না? মানে লিঙ্গগতভাবে যাঁরা ক্লীব ওরা সকলেই আপোষে থাকবে কেন? বরং ওদের সমগ্র বাঁচামরাটাই তো একটা সংগ্রাম। আপোষের তো কোনো জায়গা নেই। আমি বললাম, তাছাড়া তুমি নিজের জীবন দিয়েই জানো যে ওরা আপোষ করে না। করলে তুমি আজ হয়ত বেঁচেই থাকতে না। আরিফ আরো বলল, দাদা, আপনি কি ওনাকে একটু অনুরোধ করবেন, এই শব্দটা একটু পাল্টে দিতে। নয়ত এই অসাধারণ গানটা একটুর জন্যে নষ্ট হয়ে যাবে। আমি বললাম, অবশ্যই বলব। কাজীদা খুব সংবেদনশীল মানুষ। তিনি তোমার এই অভিমত খুবই সম্মানের সাথে গ্রহণ করবেন। তখন আরেকটা কথা বললাম, জানো তো আরিফ আমরা অজান্তে কতগুলো কথা বলি যে গুলোর অর্থ কখনো তলিয়ে দেখি না। তুমি কি এই কথাটা শুনেছো, ক-অক্ষর গোমাংস? আরিফ আকাশ থেকে পড়ল। কারণ বাংলাদেশে এই কথাটার কোনো অর্থ নেই। নেই আরিফ যে সমাজের মানুষ সেখানেও। হিন্দু সমাজে নিরক্ষর মানুষ বোঝাতে বলা হয় কথাটা। কারণ বর্ণমালা যার কাছে গোমাংসের মতই নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে ক-অক্ষর গোমাংস বললে হয়ত উচ্চশিক্ষিতই ভাবতে পারে কেউ। কারণ গোমাংস তার কাছে একটি উপাদেয় খাদ্য। আরিফ হেসে বলল, ঠিক। আমি বললাম, আমরা অজান্তেই ক্লীব কথাটাকে একটা বিশেষণে পরিণত করে দিয়েছি। এটার যে সাধারণ বিশেষ্যরূপ আছে তা বোধহয় আমাদের চেতনে থাকে না। আমি নিশ্চিত, কাজীদা অজান্তে হীন বিশেষণ হিসেবেই এটা ব্যবহার করেছেন। কাজীদাকে বিষয়টি জানাতেই তিনি সবিস্ময়ে সবিশেষ লজ্জিত হয়ে গেলেন। বললেন, সত্যিই এভাবে তো ভাবি নি। এটা কিন্তু সত্যিই গানটির মূল আদর্শগত অবস্থানের বিপরীতেই চলে গেলো। কী করা যায় বলো তো? এটা তো হাজার হাজার জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। আমি আমার এই অনিচ্ছাকৃত অন্যায়ের জন্যে ক্ষমা স্বীকার করে একটি লেখা প্রকাশ করে দিই আরিফের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে। আজ ফোন করে বললেন, গাওয়ার সময় ‘আর কতকাল থাকব বসে জীবন মৃতের এই আপোষে’ করে দেবো। আরো দুজন একই কথা বলেছে আমাকে। আমি বললাম, কাজীদা, আপনি এতটা অপরাধবোধ নেবেন না। গতকালই জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে একটি সমাবেশে আমি গাইলাম ‘ওরা আমাদের গাইতে দেয না’। গাইতে গাইতে মনে হল ‘নিগ্রো ভাই আমার’ কথাটা তো চূড়ান্ত অবমাননাকর। মার্কিন দেশে তো এই শব্দ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বহুদিন। কিন্তু কমল সরকার যখন নাজিম হিকমতের কবিতাটি অনুবাদ করেছিলেন বা যখন নাজিম হিকমত এই কথাটি কবিতায় ব্যবহার করেছেন তখন ‘নিগ্রো’ কথাটি উচ্চারণ করেও কালো মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা ব্যক্ত করা যেতো। আমি ভাবতে থাকি, শ্রীকান্ত প্রথম পর্বে ‘খোট্টা শালার ব্যাটারা আমাকে কিলাইকে কিলাইকে কাঁঠাল পাকাই দিয়া’ কথাটি শ্রীকান্ত প্রথম পর্বের হিন্দি অনুবাদে কীভাবে লেখা হয়েছিল কে জানে! কারণ একজন হিন্দিভাষী মানুষ এই বর্ণনা হুবহু দেখলে কীভাবে নেবেন। হয়ত শরৎচন্দ্রও এই কথাটি লেখার সময় হিন্দিভাষী মানুষকে অবমাননা করতে চান নি। অজান্তে অভ্যেসে লিখেছেন। মনে পড়ে, শাহ আবদুল করিমের দু’বাংলায় ভীষণ জনপ্রিয় গানটি যখন প্রথম শুনি, তখন একটা জায়গায় খটকা লেগে যায়। করিমভাই বলছেন, হিন্দুবাড়িন্ত যাত্রাগান হইত,নিমন্ত্রণ দিত, আমরাও যাইতাম। এই ‘হিন্দু’ কথাটি ও ‘আমরা’ শব্দটি বিপরীত পক্ষে বসানো দেখে আমরা অভ্যস্ত নই। আমাদের আবাল্য ভাষ্যে ‘আমরা’ পুজো করি, মুসলিমরা মসজিদে যায়। এখানে আরেকটি শব্দ ‘নিমন্ত্রণ’। এটাও করিমভাই ব্যবহার করেছেন হিন্দু বাড়ির প্রেক্ষিতেই। কারণ হিন্দুদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ হয়, মুসলিমরা দাওয়াত দেয়। এই শব্দভেদের মধ্যে কোনো বৈষম্য নেই বা নেই অবমাননা। বরং এখানে বৈচিত্রের একটি প্রকাশ রয়েছে। এভাবে দেখলে ‘ক-অক্ষর গোমাংস’ ভাষা ভূগোলের একটা বৈচিত্রেরই হয়ত ইঙ্গিত করে। এই যুক্তিমালায় অবশ্য ‘ক্লীব’ বা ‘নিগ্রো’ শব্দকে আর যুক্তগ্রাহ্য করা যাবে না। জিম্বাবোয়ের বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের নেতা এবং সেখানকার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি রবার্ট মুগাবে নাকি একবার বলেছিলেন, ‘বর্ণবাদ ততদিন থাকবে, যতদিন সাদা গাড়িগুলোর চাকা কালো থাকবে। দুর্ভাগ্য বোঝাতে কালো, আর শান্তি বোঝাতে সাদার ব্যবহার যতদিন থাকবে, ততদিন থাকবে বর্ণবাদ। বিয়ের পোশাক সাদা, আর শবযাত্রায় কালো পোশাকের চল যতদিন থাকবে, ততদিন থাকবে বর্ণবাদ। করখেলাপি বা মন্দ লোকেদের যতদিন সাদা নয়, কালোতালিকাভুক্ত করা হবে, ততদিন বর্ণবাদ থাকবে। এমন কি ¯œুকার খেলায়ও কালো বলটিকে গর্তে না ফেলা পর্যন্ত কেউ জিততে পারে না, আর সাদা বলটি বরাবর টেবিলে ওপরই থাকতে হয়।’ 
আমাদের ভাষার ভেতরেই রয়েছে এমন চোরাফাঁদ যা আমাদের অজান্তে হয়ত কখনো বিপরীত মেরুতে ঠেলে দেয়। আমাদের সিলেটের একটি লোকগানে রয়েছে, ‘ধমধমাইয়া হাঁটে নারী চোখ পাকাইয়া চায়, সেই নারী জানিয়ো নাতিন ঘর সংসার জ্বালায়। সকাল বেলায় গোবর ছিটায়, সন্ধ্যায় দেয় বাতি, সেই নারী জানিয়ো নাতিন সতী সাবিত্রী’। অনেক প্রগতিশীল শিল্পীরাও লোকায়ত সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সাধনায় ব্রতী হয়ে নারী সমাজের চরম অবমাননাকর বাণীর এই গান নিষ্ঠার সাথে গেয়ে যান। একবারও ভাবেন না, কী ভয়ঙ্কর মতাদর্শের প্রচার করছেন তাঁরা। সিলেটেরই আরো দু’টি গান, ‘জালুয়ায় ভুলাইয়া নিলো তোরে বাবনের (বামুনের) মাইয়া লো’ বা ‘বন্ধু দাঁড়াও রে প্রেমের বাতাস লাগুক গায়, সড়কে দি বন্ধু যায় বাবনের (বামুনের) মাইয়া তামসা চায়’ কে অবলীলায় পরিবর্তন করে দেন ‘সুন্দরী মাইয়া’ করে। এই পরিবর্তন কিন্তু ভয়ঙ্কর। এখানে ব্রাহ্মণ কন্যার সাথে জেলে যুবকের প্রেমকে বর্জনীয় ধরে নিয়েই এই পরিবর্তন আসে।
গান হোক, কাব্য হোক কিংবা নিছক আলাপচারিতাই হোক, ভাষার অন্দরে যে বৈষম্যের ছায়া রয়েছে, আজকের সময়ে এসে হয়ত তার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করতে হবে। 
তবে কি লেনিন রক্তে ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্যে ক্লীবতার কাছ থেকে ঋণমুক্তির কোনো পূর্বশর্ত থাকবে না?

Comments

পাঠকের পছন্দ