বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়


মানুষের মুখের কোনো একটি রেখার সামান্য পরিবর্তনেও তার অভিব্যক্তি যে আমূল বদলে যেতে পারে, সে কথা আমরা সবাই জানি যে কোনো ছবির ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য, সেটাও সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু স্বরের সামান্য একটু পরিবর্তনে সুরের অন্তর্নিহিত ভাবের যে পরিবর্তন, তা আমাকে অবাক করতো আরো বেশি।
কথাটা আরেকটু বিস্তারিত ভাবে বললে বুঝতে সুবিধা হবে। ব্যাপারটা হল এই যে, প্রতিটি রাগই যদিও সাধারণ ভাবে কিছু স্বরের সমন্বয়, তাদের আরোহন অবরোহন এবং কিছু বিধি নিষেধের সমষ্টি রূপেই বিবেচিত হয়, বিশেষতঃ যাঁরা সঙ্গীতের শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা শিল্পী তাঁদের কাছে, কিন্তু আমাদের মতো যাঁরা শুধু মাত্র সঙ্গীতের রস পিপাসু শ্রোতা, স্বরের অত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসেবের প্রতি তাঁদের আগ্রহ প্রায়শই থাকে না। সে হিসাব থাকার খুব একটা প্রয়োজনও হয়তো তাঁদের পড়েনা, কারণ ও হিসাবটা ক্রিয়াত্মক সঙ্গীত অনুশীলনে অথবা সঙ্গীতের বিষয়ে বিশ্লেষণাত্মক আলোচনায় অপরিহার্য হলেও, রস গ্রহণে নয়। কেন নয়, তারও উত্তর আছে এবং সেটা হল এই-
বহির্লোক আর অন্তর্লোকের মধ্যে যে যোগসূত্র, তার নাম ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয় পাঁচটি এবং তারা হল, চক্ষু কর্ণ,নাসিকা জিহ্বা আর ত্বক এবং এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ,স্বাদ ও স্পর্শের অনুভূতি লাভ করি-- যা থেকে আমাদের বহির্জগতের ধারণা গড়ে ওঠে। অবশ্য বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত নানা যন্ত্রের সাহায্যে আমাদের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা অনেক বাড়ানো সম্ভব হয়েছে এবং তার ফলে জগৎ সম্পর্কে আমাদের ধারণারও আরও প্রসার ঘটেছে, কিন্তু আমাদের প্রসঙ্গ আপাতত সেটা নয় ; বরং ইন্দ্রিয়লব্ধ এই বিশ্বছবিটা আমাদের চেতনায় যে ভাবের সঞ্চার করছে, আমাদের আলোচ্য বিষয় সেটাই। এটা স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, বহির্বিশ্ব যদিও আমাদের ভাবের উদ্দীপক, কিন্তু তার উপাদান হল নব রস। রসশাস্ত্রের মতে এই ন’টি রস হল, শৃঙ্গার বা আদি, বীর, করুণ, রৌদ্র, অদ্ভুত, ভয়ানক, হাস্য,বীভৎস ও শান্ত। আমাদের বিশ্বজগতের যে অনুভব, তার নির্যাস ওই নবরস।
কথাটা আরো একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক, কোনো এক নদীর ওপারে সূর্যাস্ত হচ্ছে, আর আপনি এপার থেকে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন। অস্তমিত সূর্য্যের লাল রঙ নদীর বিস্তীর্ণ জলের ঢেউয়ের ওপর প্রতিফলিত হয়ে আপনার চোখের মধ্যে উত্তল লেন্সের ভেতর দিয়ে দিয়ে রেটিনার ওপর যে প্রতিবিম্ব তৈরী করছে অজস্র নার্ভতন্ত্রীর মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ সঙ্কেতে রূপান্তরিত হয়ে তা যখন আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায়, আমরা তখন তাকে বহির্বিশ্বের ছবিটির প্রতিকৃতি মনে করি। মানে, আমরা এভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি। দুটি দৃশ্য হুবহু একই রকম হলে, কার্যকারণবাদের ভিত্তিতে আমরা ভাবতেই পারি যে, তাদের দ্বারা উৎপন্ন প্রতিচ্ছবিও একইরকম হবে, এবং তারা আমাদের মনে একই রকমের অনুভূতি বা চাবের সঞ্চার করবে ; কিন্তু সে ভাবটা ঠিক কেমন হবে, সেটা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা কঠিন, কারণ বিষয়টা তখন আর শুধুমাত্র যা দ্রষ্টব্য তার ওপর নির্ভর করছেনা, নির্ভর করছে দ্রষ্টার ওপরও।  একই বিষয় দু'জন দ্রষ্টার ওপর যে একই রকমের প্রভাব ফেলবেই এটা জোর দিয়ে বলা যায় না।     
না। সেটা খুব জোর দিয়ে বলা যায় না, কারণ তার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এরকম কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করাও হয়তো সম্ভব নয়, যার দ্বারা এটা প্রমাণ করা যেতে পারে।  কিন্তু তবু শিল্পের নিরিখে এ প্রশ্নের সুরাহা হবার একটা সম্ভাবনা যেন দেখা যায়। যদি একই বিষয় মানুষের মনে প্রায় একই রকম ভাব সৃষ্টি করতো, তাহলে শিল্প সম্ভব হত কিভাবে?
এক্ষুনি যে সূর্যাস্তের বর্ণনা দিলাম সে ছবিটা করুণ রসের সঞ্চার করে। শুধু আমার মনেই নয়, প্রায় সবার মনেই পড়ন্ত বিকেল বিষণ্ণতার উদ্রেক করে। কেন করে তা জানি না। কিন্তু এটা যে সত্য, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। রক্তাক্ত অস্তরাগের বর্ণনাটা আরো একটু বিস্তারিত করলে হয়তো বর্ণালীর আরো নানা রংও এসে যাবে, যেমন নীল, সবুজ, কমলা… এবং বর্ণনা যতই নিখুঁত হবে, মনে হয় আমাদের সবার হৃদয়ে অনুভূতির মিলটাও ততই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
এবার আরো একটা আশ্চর্য ব্যাপারের কথা আপনাদের বলব আর সেটা হল সুরের সঙ্গে রঙের একটা গভীর মেলবন্ধন আছে এবং সেই কারণেই প্রতিটি সুর আমাদের মনে একেক ছবি আঁকে, যা সঙ্গীতকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে একটা অপ্রতিরোধ্য ভাবের বন্ধনে যুক্ত করে। যেমন-- পূরবী রাগটি আমাদের চেতনা যে রঙে রঞ্জিত করে তা হুবহু ওই অস্তরাগের রঙ আর ওই পূরবী পড়ন্ত বিকেলের রাগ এবং তার রস হল করুণ রস৷ আরো সূক্ষ্মতর বিচারে বলতে পারি, পূরবী রাগটি শুনলেই আমার সামনে ভেসে ওঠে সূর্যাস্তের ওই লাল রঙের সঙ্গে আকাশের পটভূমি গাঢ় নীল রঙের দু'এক টুকরো ছেঁড়া মেঘের বর্ণনা, আর ওই রং দেখে আমি পূরবীকে চিনে নিতে পারি অব্যর্থ ভাবেই। 
পূরবীর এ ছবিটা, যা আমরা পাই উত্তর ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে। মনে পড়ছে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর গাওয়া 'মথুরা ন মোরা কাহ্না' -- খেয়ালটির কথা। পদ্মাবতী শালিগ্রামের গাওয়া --'... কাগাওয়া বোলে বোলে'-- গানটিও একই ভাবের অনুসারী। কণ্ঠ সঙ্গীতে আরো অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায় কিন্তু যন্ত্রসঙ্গীতের একটি উদাহরণ ওস্তাদ এনায়েৎ খাঁর সুরবাহারে পূর্বী আলাপ।
এই তিনটি রেকর্ড শুনলেই উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় পূরবীর যে রূপ, তার সম্যক পরিচয় পাওয়া যাবে।
কিন্তু পূরবীর আরেকটা রূপ আছে। সে রূপে বিষাদের সঙ্গে আনন্দের একটা আভাও যেন লেগে আছে এবং সেটা ঘটেছে শুধু একটি মাত্র স্বরের পরিবর্তনে। সে স্বরটি হল ধৈবত,অর্থাৎ ধা৷ উত্তর ভারতীয় পূরবীর যে স্বর সমন্বয় তা ভাতখণ্ডেহী নির্ধারিত পূরবী ঠাটের অনুসারী অর্থাৎ, 
উত্তর ভারতীয় পূরবী- স ঋ গা ক্ষ প দ ন র্স 
                                   র্স ন দ প ক্ষ গ র স (রেখাব ও ধৈবতকমল তীব্রমাধ্যম)
এ স্বর সমন্বয় পূরবী ঠাটের সঙ্গে অভিন্ন। সুতরাং উত্তর ভারতীয় পূরবীকে আমরা পূরবী ঠাটের  আশ্রয় রাগ বলতে পারি। কিন্তু এর কোমল ধৈবত স্বরটিকে বদলে আমরা যদি শুদ্ধধৈবত করে নিই, তবে সে স্বর সমন্বয় পাই সেটা হবে মারোয়া ঠাটের অন্তর্গত। পূর্বকল্যাণ রাগটিতে এই স্বর সমন্বয় ব্যবহৃত হয় এবং সেই কারণেই পূর্বকল্যাণ রাগটিকে এই ঠাটের আশ্রয় রাগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সুতরাং উত্তর ভারতীয় পূরবীর কোমল ধৈবতের পরিবর্তে শুদ্ধ ধৈবত ব্যবহার করে পূরবীর যে রূপটি আমরা পাই, যা বিষ্ণুপুরের পূরবী নামেই পরিচিত, তা আসলে মারোয়া ঠাটের অন্তর্গত। উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে এর প্রচলন নেই আর বিষ্ণুপুর ঘরাণার সূর্যও কবেই অস্তমিত হয়েছে। শুধু তার আভাটুকু আজ লেগে আছে এই বাংলার কিছু রবীন্দ্র সঙ্গীতে। সব চাইতে প্রথমেই মনে পড়ে 'আজি এ আনন্দ সন্ধ্যা, সুন্দর বিকাশে '--গানটির কথা। পূরবীর এই রূপের সঙ্গে সাজুয্য রেখে গানটির বাণীতে লেগেছে আনন্দ স্পর্শ। 
পার্থক্য শুধু ওই একটি মাত্র স্বরের, অথচ ভাবের পার্থক্যটা অনেকটাই। আর সব চাইতে বড় কথা সেটা এতটাই প্রত্যক্ষ অনুভবের বিষয় যে, স্বরান্তরের অত চুলচেরা হিসেবের মধ্যে না গিয়েও ভাবান্তরটুকুই বলে দেয়, রাগটা বদলে গেছে! যদিও নামে দুটিই পূরবী কিন্তু তবু তারা আসলে আলাদা।
আমি রাগ চিনি স্বরের হিসেবে নয়, বরং ওই রঙের হিসেবে-- যা আমার মধ্যে একটা বিশেষ ভাব বা রসের সঞ্চার করে। আর সেই রসের স্বাদই আমার কাছে রাগটির পরিচয়কে প্রকাশ করে নিশ্চিত রূপেই।
আমার বিশ্বাস কবিতা,সাহিত্য,চিত্র,ভাস্কর্য, এমনকি সঙ্গীতেরও ব্যাকরণটা মুখ্য নয়, ওটা গৌণ বিষয় এবং ভাবই হল সমস্ত শিল্পের মুখ্য বিষয়। ভাব অর্থাৎ রসই হল লক্ষ্য। ব্যাকরণ  বড়জোর পথ নির্দেশক, তার বেশি নয়। ব্যাকরণ না জেনেও যদি নির্ভুল সুরে, নির্ভুল তাল ও আঙ্গিকে সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারেন, তাহলে তাকে অবশ্যই শিল্প বলতে সমস্যা থাকার কথা নয়, তবে এ ধরণের শিল্পীকে পুরনো দিনের ওস্তাদরা নাকি 'আতাই' বলতেন। কথাটা,বলাই বাহুল্য, আদৌ প্রশংসাসূচক ছিল না। প্রশংসা বা নিন্দা আমি কোনোটাই করছি না শুধু এটাই বলতে চাইছি যে, শিল্পের আস্বাদন তার রসে, তবে সেই সঙ্গে ব্যাকরণটাও জানলে, সে কাজটা নিশ্চিত ভাবেই আরো সহজ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যাকরণের পথে রসের সন্ধান করার চাইতে, রসের ধারা অনুসরণ করে ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা অনেক সহজ।

Comments

পাঠকের পছন্দ