সঙ্গীতা চন্দ


গান! শেষ চিহ্ন দেওয়া মাত্রই যেটা প্রকট হলো লেখায়, তা হলো বিস্ময়। ছোটবেলা থেকেই যে খুব সপ্তসুরে রেওয়াজ করতাম তেমনটা নয়, সপ্তসুরের প্রতিটা সুর পৃথক পৃথক প্রতিক্রিয়া করত তখন থেকেই আমার মধ্যে। এই যেমন ধরুন, কোমল ঋষভ আর কোমল ধৈবত কানে এলে চট করে বলে উঠতাম ভৈরব রাগ, ইত্যাদি ইত্যাদি। 

গান বলতেই যেটা বিচলিত করে আমাকে তা হলো সুর ও কথার প্রণয়। যেখানেই কোনো একটা বেশি প্রাধান্য পাওয়ার চেষ্টা করে সেখানেই তৈরি হয় নানান ঘাতপ্রতিঘাত। সংস্কৃতির এই পথযাত্রায় পাথেয় হচ্ছে উৎকর্ষের জন্য আকাঙ্ক্ষা। ব্যক্তিবিশেষে সুর ও কথা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও আমি বিনাবাক্যব্যায়ে কথাকেই প্রাধান্য দেবো।  
এখন যারা সুরপ্রেয়সী তারা তাদের যুক্তি নিক্ষেপ করতেই পারে। আমি বিন্দুমাত্র ডরাইনি। 
প্রাচীন কোন আমল থেকে ঠিক গান চর্চা চালু হয়েছিল তা নিয়ে আমার বিশেষ জানা নেই। বিভিন্ন ঘরানার দ্বারস্থ হয়ে জানতে পারি তান সেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের স্রষ্টা। সে বড় বিতর্কের জায়গা। 

একজন সঙ্গীত শিল্পীই যে গানকে প্রকৃত ব্যাখ্যা করতে পারে এমনটা আমি মনে করিনা। নিজের জীবন চর্যায় একজন প্রবল সংবেদনশীল মানুষই হয়ে উঠতে পারে উৎকৃষ্ট সংগীত বিশ্লেষক।

সবসময় যে কথার ক্ষুরধারতা আমাকে সজাগ করেছে, তেমনটা কিন্তু নয়। শব্দহীন বাদ্যযন্ত্রের সুরও আমায় উত্তাল করেছে দিনের পর দিন।  সারা রাত জেগে কাটানোর পর হস্টেলের সকালে আজান ফকিরের আজান কিংবা দিনমান দুশ্চিন্তা করে শেষবিকেলে অ্যান্টনি- ফিরিঙ্গি... বইয়ের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে কবীর সুমন... সবই যেন বিনা আয়াসেই ঘটে যায় আমার জীবনে। ধীরে ধীরে তাতে বিশেষ জায়গা করে নেয় রবীন্দ্র-গান, তদুপরি গীতবিতানের লেখাগুলো। ওই যে বললাম, রবি ঠাকুরের গান সুরে যতটা না ধরা দেয়, তার চেয়ে ঢের বেশি স্পর্শ করে তার বাণী দিয়ে। মোহিত হয়ে পড়ে চলি। শুনে চলি।

সুর ও কথা ছাড়াও যে-বিষয়টি একটি গানকে বিশেষ মাত্রা দেয় তা হল ছন্দ। ছন্দহীন গানের অস্তিত্ব নেই। আবার কেউ কেউ বলবেন, ছন্দহীনতারও যে একটি ছন্দ আছে! কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমাদের কান শুধু নিখুঁতে খুঁত আবিষ্কার করতে আকুল। আমরা গান শুনি কম। বিচারক হই বেশি। সে-বিষয়ে ওস্তাদ হলে কথাই নেই, মুখরা থেকে তেহাই, বিচারে নেই রেহাই। বিচারক সত্তার ভার শ্রোতা সত্তাকে যে কখন গ্রাস করে নেয়... যার জেরে ছন্দহীনতার ঠিকঠাক ছন্দনির্ণয় করা হয়ে ওঠেনি এখনও!

গান নিয়ে কথা বলতে গেলে গান তৈরি নিয়েও কথা ওঠে প্রসঙ্গক্রমে। গানের স্বকীয় রহস্যটা কি তা নিয়ে নানান মত রয়েছে। মুহূর্তে তীব্র মধ্যম টেনে নিয়ে যায় সূর্যকে ভৈরব থেকে ইমনে।
গান ও বাজনা — দুটো পৃথক শব্দ হলেও সুপ্রাচীনকাল থেকে এ'দুটি শব্দ যেন পরস্পরের সঙ্গে লটকে আছে। পুরাতনী বাংলা গানের ক্ষেত্রে হারমোনিয়াম সর্বঙ্গীনভাবে তাকে সঙ্গ দিলেও এখন নানাবিধ যন্ত্র আগলে রাখে মায়ের মতো। তবে আমার মনে হয়, যন্ত্র কতটা যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়ায়, সেটাই বোঝার কিংবা ভাবার সময় এসেছে।

Comments

পাঠকের পছন্দ