স্বরলিপি দাশগুপ্ত


বাংলা গানে একেবারে আনকোরা এক ধারা নিয়ে অবতীর্ণ হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তান আলাপ বর্জিত বাণীব্যঞ্জনঋদ্ধ গানের জন্যই তিনি বাংলা গানের এক নতুন ধারার নির্মাতা সেই গান পরিবেশনের ধরনেও ছিল স্বকীয় তাই বাংলা গানের অন্যতম পথিকৃত দেশি-বিদেশি গানে সমপারদর্শী দিলীপকুমার রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে বলেছিলেনরবীন্দ্রনাথই আমাদের কালের যথার্থ সুরস্বাতন্ত্রের স্রষ্টা কখনও রাগ সঙ্গীত, কখনও কীর্তন বা বাউল গানের নির্যাসে গান রচনা করলেও, তাতে স্বাতন্ত্র ছিল আবার কিশোর বয়সে বিদেশে গেলে কবিকেই আবিশ্ট করেছিল পশ্চিমিগানের কারিকুরি বেশ কিছু আইরিশ স্কটিশ গানের সুর তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল শৈশব থেকেই তাঁর পরিবারেও ইউরোপীয় গানের যথেষ্ট চর্চা ছিল 

ঠাকুর বাড়িতে প্রথম ইউরোপীয় সঙ্গীতের আবহ তৈরি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪৩ সালে ইংল্যান্ড থেকে প্রথম তিনিই একটি ব্যারেল অর্গ্যান কেনেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও পিয়ানো অর্গ্যান বাজাতে পারতেন দেবেন্দ্রনাথের বড় ছেলে তথা রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংলিশ ফ্লুট বাজাতে পারতেন এমনকি তিনি স্টাফ নোটেশন পড়তে পারতেন রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি তৈরির প্রথম পরিকল্পনা ছিল তাঁরই আর এসবের মধ্যে বড় হয়ে পশ্চিমি সঙ্গীত সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয় রবীন্দ্রনাথেরও বিদেশি অপেরা হলেই শুনতে যেতেন শুধু বিদেশি সঙ্গীত নয় বিদেশি সাহিত্যও আকৃষ্ট করেছিল তাঁকে পশ্চিমের সাহিত্যে উদার চিন্তার জন্যই তিনি মাত্র ১২ বছর বয়সে অনুবাদ শুরু করেছিলেন দান্তে, হুগো, রসেটি, শেলি-সহ আরও অনেকের কবিতা অনুবাদ করেছেন বিভিন্ন উপন্যাসেও তিনি বিদেশি কবিতার তর্জমা ব্যবহার করেছেন 

১৭ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে গিয়ে বিলেতি সঙ্গীতের দ্বারা বিশেষ ভাবে আচ্ছন্ন হন রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে তিনি লিখছেন, "ব্রাইটনে থাকিতে সেখানকার সংগীতশালায় একবার একজন বিখ্যাত গায়িকার গান শুনিতে গিয়াছিলাম তাঁহার নামটা ভুলিতেছি- মাডাম নীলসন্ অথবা মাডাম আলবানী হইবেন কণ্ঠস্বরে এমন আশ্চর্য শক্তি পূর্বে কখনো দেখি নাই"   এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি গানের সঙ্গে তাঁর যাপন শুরু করেন ডক্টর এম এর বাড়িতে প্রায়ই আসর বসত সেখানে ইংরেজি গান গাইতেন তিনি সঙ্গে বাজাতেন মিস  

জীবনস্মৃতিতে কবি লিখেছেন, "দেশে ফিরিয়া আসিয়া এই সকল এবং অন্যান্য বিলাতি গান স্বজনসমাজে গাহিয়া শুনাইলাম সকলেই বলিলেন, রবির গলা এমন বদল হইল কেন, কেমন যেন বিদেশী রকমের, মজার রকমের হইয়াছে এই প্রসঙ্গে ইন্দিরা দেবী স্মরণ করে বলেছিলেন, সেই সময় থেকেই বিলিতী সংগীতের সঙ্গে তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) পরিচয় হয় এবং শুনেছি তাঁর সুরেলা, জোরালো, তার সপ্তকের চড়া গলা, যাকে ওদেশে বলে টেনর্ - শুনে ওরা মুগ্ধ হতো"

গান পরিবেশন করার ধরন, গান পরিবেশনের আগের নিখুঁত প্রস্তুতি থেকে শিল্পীর কণ্ঠস্বর সমস্তই আকৃষ্ট করেছিল রবীন্দ্রনাথকে কিন্তু কোথাও গিয়ে তিনি মনে করেছিলেন, বিলেতে বাহ্যিক আয়োজনের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় গানের ভাব মর্মস্পর্শী হল কি না, বা সুরের ওঠানামার সঙ্গে কথার মেলবন্ধনে শ্রোতা কতটা বিলীন হলেন, তার চেয়েও বেশি গায়কের কণ্ঠস্বরের পারদর্শীতার উপরে বেশি আলোকপাত করা হয় তিনি জীবনস্মৃতিতে বলছেন, "আমাদের দেশে যারা প্রকৃত শ্রোতা তারা গানটাকে শুনিলেই সন্তুষ্ট থাকে, য়ুরোপে শ্রোতারা গান-গাওয়াটাকে শোনে"   

ব্রাইটনে সেদিন সেই গায়িকার নিখুঁত কণ্ঠস্বরে অবাক হয়েছিলেন কবি কিন্তু সর্বপরি তাঁর গানটি শুনে ভালো লাগেনি তিনি বলছেন, "মনে যতই বিস্ময় অনুভব করি, সেদিন গানটা আমার একেবারেই ভালো লাগিল না বিশেষত তাহার মধ্যে স্থানে স্থানে পাখির ডাকের নকল ছিল, সে আমার কাছে অত্যন্ত হাস্যজনক মনে হইয়াছিল মোটের উপর আমার কেবলই মনে হইতে লাগিল মনুষ্যকণ্ঠের প্রকৃতিকে যেন অতিক্রম করা হয়েছে"

বিলেতের গানের পরিবেশন নিয়ে এরকম অনুভূতি প্রকাশ করলেও, গানের সুরে তিনি বেশ আকৃষ্টই হয়েছিলেন জীবনস্মৃতিতে তাই কবি বলছেন, "আমি যখনই য়ুরোপীয় সংগীতের রসভোগ করিয়াছি, তখনই বারংবার মনের মধ্যে বলিয়াছি ইহা রোমান্টিক মানবজীবনের বিচিত্রতাকে গানের সুরে অনুবাদ করিয়া প্রকাশ করিতেছে আমাদের সংগীতে কোথাও কোথাও সে চেষ্টা নাই যে তাহা নহে, কিন্তু সে চেষ্টা প্রবল সফল হইতে পারে নাই

বিলেত থেকে ফেরার পরে ১৮৮০ সালে 'বাল্মিকী প্রতিভা' গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন কবি নাটকের চেয়ে সঙ্গীতকেই এখানে বেশি গুরুত্ব দেন তিনি এটিই বাংলার প্রথন গীতিনাট্য পাশ্চাত্যের ছাপ থাকা এই গীতিনাট্যে বিলাতি সুরের অনুকরণে তিনটি গান রচনা করেছিলেন তিনি সেগুলি হল- 'কালী কালী বলো রে আজ', 'তবে আয় সবে আয়' এবং 'মরি কাহার বাছা' 

১৮৮২ সালে স্কটল্যান্ডের গান 'Ye Banks and Braes' এর অনুকরণে তৈরি করলেন 'ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে' ১৮৮৫ সালে বেন জনসনের লেখা ইংরেজি গান 'Drink to with only thine eyes' থেকে রচনা করেন 'কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া' সুরে অনুপ্রাণিত হলেও, কথায় স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ওই একই সালে স্কটল্যান্ডের কবি রবার্ট বার্নসের বিখ্যাত গান 'Auld Lang Syne' এর সুরে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি রচনা করলেন 'পুরানো সেই দিনের কথা' তিনি মূলত, আইরিশ, স্কটিশ গানের সুর অনুসরণ করেছিলেন 

বিদেশি গানের নির্যাস বৃদ্ধ বয়সেও থেকেছে কবির গানে স্বদেশ পর্যায়ের গান 'সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান' গানটির চলন মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায় এর মধ্যেও রয়েছে পশ্চিমি গানের ছাপ  এই গানটি শান্তনিকেতনে এক ক্রীড়া অনুষ্ঠানের জন্য রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

'বাল্মিকী প্রতিভা'- মতোই আরও একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলে কবি 'কাল মৃগয়া' ' দেখবি রে ভাই', 'তুই আয়রে ছুটে আয়'-সহ অধিকাংশ গানের সুরই পাশ্চাত্য সুরের অনুকৃত 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে পাশ্চাত্য স্বরলিপি পড়তে পারতেন সেই স্বরগুলির ভিন্ন চরিত্র গানের কথার সঙ্গে মেলাতেন বিদেশি সুর থেকে অনুপ্রাণিত হলেও, তাই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টিকে স্বকীয়তা বজায় থাকত তাঁর গানে স্বরের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়ার মধ্যেও ছিল স্বতন্ত্র 'সে কোন বনের হরিণ' গানটিতে, সা থেকে প্রথমে শুদ্ধ গা, তার পরে মা, আবার উপরের সা এই অনায়াসে স্বরের অনুরণন সম্ভব হয়েছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীত পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র পিয়ানো, বেহালা নিয়ে তাঁর জ্ঞানের জন্য 

বিদেশের বেশ কিছু গানের সুর থেকে সরাসরি অনুপ্রাণিত হয়েছেন তিনি আবার তাঁর কিছু গানের স্বরের চলন, পরিবেশনের ধরন লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, তাতেও রয়েছে পশ্চিমি সঙ্গীতের নির্যাস কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বকীয়তা ছাপিয়ে যায়নি তা প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মিশেলেও নিজের ঘরানাই প্রাধান্য় পেয়েছে ঠিক কতটা পরিমাণ সুর কোন কথার সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করবে এবং তা যুগ যুগ ধরে আধুনিক থেকে যাবে সেই রসায়ন তিনি বুঝেছিলেন তাই তো তিনিই লিখেছিলেন, 'আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী' 




তথ্যসূত্র
জীবনস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 
রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা- শান্তিদেব ঘোষ
এলেম নতুন দেশে- সুধীর চক্রবর্তী

   

Comments

পাঠকের পছন্দ