মুখোমুখি : দুর্নিবার সাহা



পান্থজন : তুমি প্রথম সঙ্গীত জগতে এলে কী করে?
দুর্নিবার : আমি বলব আমার পরিবারের কারণেই আমি সঙ্গীত জগতে এসেছি। আমার পরিবারের প্রায় সবাই গান গাইতে পারে। কিছু না কিছু। তাদের শুনে শুনেই গানের প্রতি আগ্রহটা তৈরি হওয়া। ব্যাস, এটাই। আমার পরিবারই আমায় এনেছে সঙ্গীত জগতে। 
পান্থজন : তোমাকে সঙ্গীত তৈরি করার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা কে দিল?  
দুর্নিবার : কে আমায় সঙ্গীত তৈরি করতে অনুপ্রানিত করেছে? তাহলে বলতে হয় সৌনক, আমার কলেজের এক বন্ধু। ওর সাথেই আমি আমার প্রথম গানটি তৈরি করি।
পান্থজন : সাধারনত যে ধরনের সঙ্গীত তুমি তৈরি করো, তাকে কীভাবে বর্ণনা করো? 
দুর্নিবার : আমি জানিনা, আমার সঙ্গীতকে আমি কীভাবে বর্ণনা করব তা সত্যি জানি না। এটা স্রোতারা বলতে পারবেন। তাছাড়া তারা আমার নিজস্ব সঙ্গীত শোনেননি। আর যেটুকু শুনেছেন তা অন্য কারোর তৈরি করা। তবু যদি বলেন আমি কী আঙ্গিক নিয়ে কাজ করি তাহলে বলব তা গসপেল, সোল, জ্যাজ ও ব্লুজের মিশ্রন। সবই ভালো লাগে, আর সব শেষে সেটাই ভালো লাগে যা আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যা আমার স্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যা তোমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। 
পান্থজন : তোমার সৃষ্টিশীলতার পদ্ধতিটা কী?
দুর্নিবার : আমার সৃষ্টিশীলতার পদ্ধতি বলতে এটাই বলব যে, প্রথমে আমার চিন্তার গভীরে গিয়ে ভাবব, তার কিছু আবিস্কার করব আর তারপর ঠিক কোথা থেকে শুরু করবো সেটা খুঁজে নেব। এরপর আমি শুধু এগিয়ে যাই এবং গানটা তৈরি করে ফেলি। 


পান্থজন : তুমি কার সাথে জোট বেঁধে কাজ করতে ইচ্ছুক? 
দুর্নিবার : আমি বিশ্বের সমস্ত মহান সঙ্গীতজ্ঞদের সাথেই কাজ করতে চাইবো। আমার শহরের সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে চাইব তো বটেই। প্রথমে তাঁরা, তারপর সমগ্র ভারত আর তারপর সমগ্র বিশ্বের তাবড় সঙ্গীতজ্ঞদের কাজ করতে চাইব। বিশ্বের বাইরের কেউ বা কোনও কিছুর সাথেও যদি সম্ভব হয়, তাহলে তাদের সাথেও কাজ করতে চাইব। নির্দ্দিষ্ট কিছুই নয় যদিও। 
পান্থজন : তোমায় যদি কোনও শিল্পীর অনুষ্ঠানের উদ্বোধন  করতে বলা হয় তাহলে তুমি কোন শিল্পীর জন্য তা করতে চাইবে?
দুর্নিবার : ববি ম্যাক্সিমকে আমি আমার সঙ্গীতের দেবতা হিসেবে মানি। আমার জন্য এটা একটা অনন্য অভিজ্ঞতা হবে যদি আমি ববি ম্যাক্সিমের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার সুযোগ পাই। এটা স্টিং-এর জন্য করতে পারলেও আমার ভালো লাগবে। 
পান্থজন : তোমার ভক্তদের তুমি কী বার্ত্তা দিতে চাও?
দুর্নিবার :  আমার দিকে তাকানো বন্ধ করো, আমার গান শোনো। 
পান্থজন : তোমার সব থেকে অপ্রয়োজনীয় প্রতিভা কোনটা?
দুর্নিবার : আমার অতিরিক্ত আলস্য। 
পান্থজন : তুমি কি স্নান করতে গিয়ে গান করো? করলে কোন গানগুলো করো?
দুর্নিবার : কে গায় না? সকলেই গায়। যারা পেশাদার গায়ক নন, তারাও গান। আমিও গাই। নির্দিষ্ট কিছু নেই। তবে যেগুলো ধরো, সকালে শুনেছি, বা আগেরদিন শুনেছি বা বিকেলে শুনেছি। মানে যেগুলো মাথায় ঘোরে সেই গানগুলো গাই। 
পান্থজন : সঙ্গীত কে পেশা না করলে তোমার পেশা কী হতো? 
দুর্নিবার : আমি তাহলে ছবি তুলতাম। আরও মনোযোগ দিয়ে সিনেমা বানাতাম।
পান্থজন : ইন্টারনেট মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে কীভাবে প্রভাবিত করে বলে মনে করো?
দুর্নিবার : ইন্টারনেট আসার প্রথম দিকে লোকে পাইরেটেড গানের এম.পি.থ্রি ডাউনলোড হওয়া শুরু হল। তারপর ইউটিউব ও স্পটিফাই-এর মতো মাধ্যম আসার পরে পুরোনো শিল্পীদের গানও আমাদের প্রজন্মের কাছে সহজলভ্য হয়ে গেছে। তাই আমার মতে, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির ওপর ইন্টারনেটের ভালো ও মন্দ, দুরকম প্রভাবই আছে বলে আমি মনে করি। ইন্টারনেট এর প্রভাব বাড়ছে, দেখা যাক। 
পান্থজন : তোমার কোন প্রিয় গানটা তুমি গাইতে ভালোবাসো?
দুর্নিবার : আমার একটা প্রিয় গান আছে। তবে অনেক গানই আছে। আমি অনেক শিল্পীর অনেক আঙ্গিকের অনেক গানই ভালোবাসি গাইতে। বাংলা ও হিন্দি আঙ্গিকের তো বটেই। তবে যে গানটা আমি গাইতে সব থেকে ভালোবাসি সেটা হলো "মোরা সাঁইয়া"। গানটা "ফিউজন" ব্যান্ডের "সাগর" অ্যালবাম থেকে নেওয়া। গানটির নাম "খামজ"। আমার গানের মধ্যে আমার প্রিয় গান হলো "উধাও"। এই গানটা আমি সত্যি ভালোবাসি। 
পান্থজন : কোন সঙ্গীতজ্ঞের কাজের প্রতি তুমি মুগ্ধ?
দুর্নিবার : যদি বলি আমি মুগ্ধ, তবে আমি বলব মানু কাচ্চের কাজের আমি ভক্ত। উনি একজন ফরাসী ড্রামার। কলকাতার শিল্পীদের মধ্যে সুমিত রামাচন্দ্রনের কাজেরও আমি খুব বড় ভক্ত। উনি একজন গিটারিস্ট। এবং অবশ্যই জাকির হুসেন। আমি ওনাকে ভালোবাসি।
পান্থজন : সব চেয়ে বড় কোন বিপদে পড়েছ?
দুর্নিবার : এই প্রশ্নটা মজার। কোনও এক শো-তে, কোথায় ঠিক মনে নেই। আমি আর আমার ব্যান্ড স্টেজের ওপরেই আটকা পড়ে গেছিলাম। কারণ দর্শকরা বেরোনোর সব পথ আটকে রেখেছিল। রীতিমতো যুদ্ধ করে আমাদের স্টেজ থেকে বেরোতে হয়েছিলো। এটাই সব চেয়ে বড় বিপদে পড়েছি আমি। ওটাকে একটা বিপজ্জনক মুহূর্ত বলব আমি।
পান্থজন : কোথায় কোথায় অনুষ্ঠান করেছ? সব চেয়ে প্রিয় ও অপ্রিয় অনুষ্ঠানের জায়গা কোনগুলো?
দুর্নিবার : অনেক জায়গাতেই অনুষ্ঠান করেছি। কলকাতায় তো বটেই, সারা পশ্চিমবঙ্গেই অনুষ্ঠান করেছি। এছাড়া হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, মুম্বাই, পুনে, আসাম, মেঘালয়, বিহার, জামশেদপুরে অনুষ্ঠান করেছি। ভারতের বাইরে বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর, দুবাই, কুয়েত, আমেরিকার কিছু শহরে, কানাডায় আমি অনুষ্ঠান করেছি। অপ্রিয় জায়গা বলতে কিছু নেই। তবে বলব, যে জায়গার স্রোতা গান শোনেনা, সেখানটা আমার অপ্রিয় জায়গা। তবে যদি আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গার নাম জানতে চাওয়া হয়, তাহলে বলবো শিকাগোর হেম্যান্ডস, দুর্দান্ত একটা অডিটোরিয়ম। কলকাতার মধ্যে জি.ডি.বিড়লা সভাঘরও খুব প্রিয়।
পান্থজন : তোমার আগামী কোনও অনুষ্ঠান আছে কি?
দুর্নিবার : সৌভাগ্যক্রমেই হোক আর দূর্ভাগ্যক্তমেই হোক, আজই আমার একটা অনুষ্ঠান আছে। ডিজিটাল কনসার্ট তো আছেই, আমার কাজও হচ্ছে। 
পান্থজন : সব চেয়ে ভালো উপদেশ কী পেয়েছ?
দুর্নিবার : সব সময় নিজের ধারণাকে শোনো, নিজের ধারণাকে প্রশ্ন করো, নিজের ধারণা কে ভরসা করো। সাহস ও সততাকে সঙ্গী করো। 
পান্থজন : ইন্ডাস্ট্রির কিছু পরিবর্তন করতে হলে কী পরিবর্তন করবে?
দুর্নিবার : সমস্ত কিছুই। আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির কোনও পদ্ধতির অস্তিত্ব আছে কি না জানিনা। তাই কোথা থেকে শুরু করতে হবে, কোথায় শেষ করতে হবে জানিনা। আমার জানা নেই এমন কিছু আছে কি না। কারন সঙ্গীত আমাদের সকলের, শিল্পীদের জীবনের ও স্রোতাদের জীবনের একটা অনন্য অঙ্গ কারন স্রোতারাই গান শোনেন। প্রথমত আমি একটা লিখিত খসড়া চাই যাতে সমস্ত নতুন শিল্পীরা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন ও তারা তাদের জ্ঞানের আদান-প্রদান করবেন। এরকম কেউ অদরকারি যে জানতে চাইবে শিল্পীর বাবা-মা এর থেকে যে সে কী করতে চায়। এমন কোনও শিল্পী বা সঙ্গীতজ্ঞকে চাইনা যার কাছে এই উত্তরগুলো নেই। আমি চাই কংক্রিট কিছু হোক যাতে কে কী করবে তা জানা থাকে। এই পরিবর্তনগুলোই আমি করব। আর যেটা করতে চাই, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে একটা ধূর্ত লবিবাজি করা লোক আছে যারা বাছাই করা লোকেদের বাছাই করা কাজের জন্য ধরেন। যদিও আমি এই ইন্ডাস্ট্রিতে চার পাঁচ বছর হল আছি, তবে আমার এখনও এদের গুলে খাওয়া হয়নি। আমার এই দলগুলোর ফন্দি-ফিকিরের সম্যক জানা নেই আর জানার ইচ্ছাও নেই। আমি আমার কাজ নিয়েই ভালো আছি। আমি এমন একটা ইন্ডাস্ট্রি চাই যেখানে গানের লেখকরাও গুরুত্ব পাবেন, স্টুডিওগুলো গুরুত্ব পাবে, সুরকাররা গুরুত্ব পাবেন, শিল্পীরা ও প্রোডাকশনের সকলে গুরুত্ব পাবেন ও প্রাপ্য সম্মানটুকু পাবেন কারণ আমি জানি সেটা ওরা পান না। 
পান্থজন : এর পরে কী করতে চাও?
দুর্নিবার : আমি গান গাইব, ছবি তুলব আর নতুন নতুন জিনিস জানার চেষ্টা করব। এটা একটা কঠিন সময়, পরের মাসে বা পরের বছরে কী হবে আমরা কেউ জানিনা। আমি আমার চোখ-কান খোলা রাখছি, সেই সাথে মাথা আর দূরদর্শীতাকে খোলা রাখছি। আগামী পরিবর্তনগুলির সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করব। এটাই আমার কাছে পরবর্তী পদক্ষেপ। আমার মনে হয় সবাই এটাই করার চেষ্টা করছে। নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকব। মানুষ আমার থেকে যা চান তা দেওয়ার চেষ্টা করব আর আমি আমার ইচ্ছাগুলো পূর্ণ করার চেষ্টা করব, অবশ্যই কারোর ক্ষতি না করে। আর তোমার মতো বন্ধু যখন আছে তখন এক সাথে ভালো কাজ তো করবই। 

Comments

পাঠকের পছন্দ