তানিয়া ঘোষ


'এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন,কবে যাবো তবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ'--
দিনটা শুরু হল বৃষ্টিভেজা আমেজ নিয়ে। খুব চেনা সেই জানালার পাশ,চায়ের কাপে আলতো চুমুক। বাইরেটা কিছুটা ঝাপসা এবং চেনা চারপাশটা বেশ আবছা। আজকের দিনে এই গানটা ছাড়া আর কিই বা মনে আসতে পারে। গান কমবেশি আমাদের সবারই খুব পছন্দের। আমার জীবনের সঙ্গেও গানটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।মনের বিভিন্ন অবস্থার সঙ্গে বিভিন্ন গান প্রাসঙ্গিক। সেরকমই দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাগ ও রাগ ভিত্তিক গানের প্রচলন বহুকাল ধরেই চলে আসছে। যেমন বলা যায় সকালের রাগ গুলির মধ্যে অন্যতম রাগ ভৈরব, রাগ বিভাস, রাগ হিন্দোল, রাগ লীলাবতী। সেরকম বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাগগুলিরও পরিবর্তন ঘটে।

এখন দুপুর গুলির মধ্যে যেন আলস্য একটু বেশী। আজকের এই অলস দুপুরের সাথে যেন বাইরের সোঁদা গন্ধটা মিলেমিশে একাকার। এমন সময় গানের ডাইরির পাতা উল্টোতে গিয়ে চোখে পড়ল 'বৃন্দাবনী সারং' রাগটি। দুপুরকালীন রাগের মধ্যে এই রাগটি অন্যতম। ফরাসী ভাষায় 'সারং' শব্দের অর্থ মেঘ। অর্থাৎ সারং রাগটিতে বর্ষার স্পর্শ আছে একথা স্বভাবতই মনে হবে,কিন্তু সারং সেই অর্থে বর্ষার রাগ বলা যায় না, বরং গ্রীষ্মই এর ঋতু। তবে ভেতরে মেঘের সঞ্চার শুরু হয়েছে এবং তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে--সারং এর সময় গ্রীষ্মের শেষের দিক যা আজকের দিনের সাথে যথাযথ।এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে বৃন্দাবনী সারং এর সুন্দর ভাবে প্রকাশ ঘটেছে। সেই অর্থে দুটি প্রাসঙ্গিক গান মনে পড়ে। প্রথমটি হল-- 'আমি এলেম  তারি দ্বারে, ডাক দিলেম অন্ধকারে।' দ্বিতীয়টি হল-- 'চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো,তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।

গান নিয়ে ভাবতে বসলে সভয় কিভাবে কেটে যায় তা বোঝা মুশকিল। সেরকমই আজ মেঘলা দিনে হয়তো একটু তাড়াতাড়ি ই সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এল। দিনের শেষে সন্ধ্যের আকাশে আবার নক্ষত্রেরা স্বমহিমায় নিজস্থানে ফিরে আসে। কিন্তু আজকের আকাশে মেঘেরা খুব আদর করেই তাদের চাদর টেনেছে, সেই স্পর্শকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল 'ইমন কল্যান' রাগটির কথা, যার শাস্ত্রীয় রূপটি একটি শান্ত সন্ধ্যার ছবি আঁকে।আলাউদ্দীন খিলজীর সভাসদ ও দার্শনিক হযরত আমীর খসরু এই রাগটির স্রষ্টা। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু গান মনে পড়ে। এই রাগটিকে আশ্রয় করে তিনি বহুবার ঘন বর্ষার ছবি এঁকেছেন। যেমন --'আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো', 'হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ', 'আজ বারি ঝরে ঝরো ঝরো।' বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা আরও তাৎপর্যমন্ডিত হয়ে ওঠে গানগুলির সাথে।

গান শোনার অভ্যেসের সঙ্গে গানের কথা ও সুর দুটিই অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। আমরা কেউ গান শুনি নিজের অন্তর দিয়ে, আবার কেউ বা মস্তিষ্ক দিয়ে।৷ এক-এক টা গান এক-এক রকম ভাবে মানুষের আবেগের সাথে জড়িত। দিনের শেষে প্রতিটি মানুষের ভেতরকার অপিরিচিত অন্ধকারটা আরও গাঢ় হয়। কেবলমাত্র গান ই দিতে পারে কিছুটা স্বস্তি ও শান্তি। কেউ গানকে তার আবেগ দিয়ে স্পর্শ করতে চায় আবার কেউ বা পেতে চায় অবলম্বন হিসাবে। একটা দিন হয়তো ফুরিয়ে যায় কিন্তু থেকে যায় কিছু  স্মৃতি, সেই স্মৃতিচারণে সাহায্য করে কিছু বিশেষ গান। এখানেই হয়তো গানের সার্থকতা ও প্রাসঙ্গিকতা--
'ফিরে ফিরে আসে ঢেউ,ছায়ারাও হচ্ছে বড়,
ঝিনুকের মত দিন, কুড়িয়েও দেখতে পারো,
এ ঘরের গভীরে নোনাধরা শরীরে,
একমুঠো রোদ্দুর বহুদূর হয়ে থাকো তুমি--
এই মেঘলা মনের গান, আমার বড্ড অভিমান,
তাকে ঘুম পাড়াবো স্বপ্ন আসবে বলে।

Comments

পাঠকের পছন্দ