মোনালিসা মুখার্জী


মাদের জীবনটা সঙ্গীতের মতোই তরঙ্গায়িত, ঘটনাবহুল। নীড়চ‍্যুত পাখি যে রকম অসহায়তার শিকার হয়, সঙ্গীতবিহীন একজন সঙ্গীতপ্রেমীর যাপনও সেরকমই দিশাহীন, অনর্থক। নিজের কথাই বলতে পারি এ প্রসঙ্গে। আমার নয়মাস বয়স যখন, যখন একটি শিশু প্রথম আধো আধো স্বরে মা বাবা ডাকতে শেখে, ঠিক সেই বয়সটি থেকে আমি সুর ভাঁজতাম, গান গাইতাম বলা চলে না কারন তখনও মুখনিঃসৃত শব্দগুচ্ছ অর্থবহ হয়ে ওঠেনি। এসব মায়ের মুখে শোনা। যখন একটু বোধ হল, দাদু হলেন আমার প্রথম সঙ্গীতগুরু, তাঁর হাত ধরেই সাতসুরের অক্ষরপরিচয়। দাদু অসাধারণ দক্ষতায় হারমোনিয়াম বাজাতেন, আর আমার রূপকথার কল্পনার জগতজুড়ে সীমাহীন বিস্ময় খেলা করত। মামার বাড়িতে গানবাজনার চর্চা হত খুব, প্রায় প্রতিদিন ঘরোয়া আসর বসত। গ্রামদেশে প্রায়ই বিকেলের পর লোডশেডিং। হ‍্যারিকেনের আলোয় সেই সঙ্গীতমুখর সন্ধ‍্যা আরও মায়াবী হয়ে উঠত। সেইসব সান্ধ্যজলসা থেকে উঠে আসত "স্বপ্ন জাগানো রাত মাধুরী ছড়ায়", "আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি", "কী দেখি পাই না ভেবে গো" অথবা "ও মন কখন শুরু কখন যে শেষ" । সেই থেকে আমার বিস্ময়ের আর মাত্রা রইল না। গান শুনলে এত প্রশান্তি আর প্রাণের আরাম সেই তখন থেকে উপলব্ধির শুরু। আমিও শিখে ফেলতে লাগলাম কখনও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় কখনও বা মান্না দে কখনও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কঠিন কঠিন সব গান। সেই বয়সে সেগুলো গান হত কিনা জানিনা তবে একটা দুঃসাহসিক চেষ্টা ছিল নিঃসন্দেহে। যখন আর একটু বড় হলাম, বুঝতে পারলাম এই একটি বিষয় আমাকে যেমন তৃপ্ত করছে অন্তর থেকে কখনও আবার তুমুল অস্থির করে তুলছে। সেই অস্থিরতা কমত না কিছুতেই যতক্ষণ না কোনও গান ঠিকমত সুরে সুরে লাগত। তারপর শুরু হল মনে মনে গানের সুর তৈরি ; কথা পেতাম না খুঁজে, শুধু সুরই হত। আমি বরাবরই লাজুক ছিলাম ভীষণ। সেই সৃষ্টিটুকু পরিবারের কাউকে শোনানোর মতো আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করা হয়ে উঠত না আর। তখনকার দিনে প্রযুক্তির অগ্রগতি হয়নি এতটা, তাই চাইলেই কোনও কিছু রেকর্ড করে রাখা সম্ভব ছিল না। সেগুলো তাই বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে গেল চিরকালের মতো। এখন আর চেষ্টা করেও চিন্তা করেও আসে না কিছুই । দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন প্রথম প্রথাগত গানের তালিম নেওয়া শুরু হল। মনে আছে প্রথম শিক্ষাগুরুর থেকে প্রথম শেখা গানটি ছিল "বেলা বয়ে যায়, ছোট্ট মোদের পানসি তরী , সঙ্গে কে কে যাবি আয়"। গানটিতে আমার ছোটবেলার গন্ধ মিশে আছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার গানের ঝুলিও সমৃদ্ধ হতে থাকল। কখনও নজরুলগীতি, কখনও প্রেম, প্রকৃতি অথবা বিচিত্র পর্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত । তৃতীয় শ্রেণীতে স্কুলে 'তাসের দেশ' নৃত্যনাট‍্যের রিহার্সাল শুরু হল। গানের সুর ঠিকঠিক লাগাতে পারতাম বলে আমাকে কয়েকটি গানে নির্বাচন করলেন শিক্ষিকারা। চরিত্র হিসেবে দেওয়া হল হরতন আর আমাকে দিয়ে গাওয়ানো হল "এলেম নূতন দেশে" আর "চিড়েতন, হরতন, ইস্কাবন, অতি সনাতন ছন্দে"। টেপরেকর্ডারে রেকর্ড হল অনুষ্ঠানের দিন আবহ হিসেবে বাজানো হবে বলে। ভীষণ উত্তেজনা আর আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম সেইদিন। 

মনে পড়ে, একবার নৈনিতাল বেড়াতে গেছি। ২০০৫ সাল। সূর্যোদয় দেখতে হোটেল থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা জঙ্গলের মধ‍্যে ঢুকে পড়েছি। আমি স্বভাববশত কোনও একটি গানে নিমগ্ন হয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণে ব‍্যস্ত। হঠাৎ পিছন থেকে বাংলা কথা শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখি প্রৌঢ় দম্পতি এতক্ষণ আমার পিছনে দাঁড়িয়ে গান শুনছিলেন। অত‍্যন্ত সঙ্গীতানুরাগী সেই ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা বাবা মার কাছে আমার গান নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। কথায় কথায় জানা গেল যে হোটেলে আছি আমরা সেটা ঘটনাচক্রে ওনাদেরই এবং সবথেকে মজার ব্যাপার হল বাকি যেকটা দিন ঐ হোটেলে ছিলাম ওনারা আমাদের থেকে কোনো টাকাপয়সা নিলেন না। চলে আসার দিন বাবাকে বললেন এটা তাদের তরফ থেকে আমার জন‍্য।

আরও একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। নবম শ্রেণীতে পড়ি তখন। ইংরাজী টিউশনের স‍্যার স্টুডেন্টদের নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালনে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। ঠিক হল স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হবে। গান নাচ আবৃত্তির রিহার্সাল শুরু হলো প্রতিদিন ক্লাসের পরে । আমাকে দেওয়া হল সঞ্চালনার দায়িত্ব আর তার সঙ্গে দুটি গান গাইব বলে ঠিক করলাম , "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি" আর "অ‍্যায় মেরে য়তন কি লোগো"। মূল অনুষ্ঠানের দিন ক্ষুদিরামের ফাঁসির গানটি গাইছি। সেই গানের করুণ সুরে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে। হঠাৎ চোখ পড়লো পাশের বাড়ির দোতলার জানালার দিকে। জানালার ধারে বসে এক অশীতিপর বৃদ্ধা আমার গান শুনে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছেন। এ কী অপ্রত্যাশিত দৃশ‍্য দেখালেন আমায় ঈশ্বর!রুদ্ধ হয়ে গেলাম কয়েক মুহূর্ত!

মহালয়ার রেডিও অনুষ্ঠান "মহিষাসুরমর্দিনী"র গানগুলি আমার চিরকালই বড় পছন্দের ছিল। স্কুলে একবার আগমনী অনুষ্ঠানের জন্য "বাজলো তোমার আলোর বেণু" গানটি প্রস্তুত করে নিয়ে গিয়েছিলাম।গানটি আমাকে প্রথম থেকে শেষ অবধি পরপর তিনবার গাইতে হয়েছিল, কারণ যতবার শেষ হচ্ছে পুনরায় প্রথম থেকে গাওয়ার অনুরোধ আসছে স্কুলে আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথিদের কাছ থেকে। এইসব স্মৃতি মনে পড়লে আজও অবাক লাগে। সত‍্যিই গান আমায় কত কিছুই না দিয়েছে! এভাবেই আমার আশৈশব জীবনকে অভিনব ঘটনাবৈচিত্র‍্যে ভরিয়ে তুলেছে গান। 

এরপর আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গীতও শৈশব থেকে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উপনীত হলো। আজও এই একটি বিষয় সম্পূর্ণ নিজের হয়ে থেকে গেছে ।পরম বন্ধুর মত শুশ্রূষা দিয়েছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে । আজও কোনও প্রিয় গান শুনলে অন্তর থেকে শিশুসুলভ উন্মাদনা অনুভব করি সেই ছোট্টবেলার মত। আজও পাগলামির মত কোনও গান চেপে বসলে সেই একটি গানের পুনরাবৃত্তিতে রাত কাবার হয়ে যায় যতক্ষণ না স্বরযন্ত্র বিদ্রোহ করছে! কখনও আমার সাধের দুঃখবিলাসী মন খুঁজে খুঁজে বেড়ায় কোনও করুণরসের মায়ামাখা গান। এরকমই একটি বিখ্যাত অতুলপ্রসাদী "পাগলা, মনটারে তুই বাঁধ"। এই গানটি আমার হৃদয়ের ঠিক কতটা গভীরে প্রোথিত তা হয়ত নিজেও বুঝিনা। সঙ্গীত নিয়ত আমাকে ঋণী করে চলেছে এভাবেই আর বোধ করি আমৃত্যু সঙ্গীতই আমায় শৈশবের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে রাখবে।

Comments

পাঠকের পছন্দ