শ্বেতা চক্রবর্তী
নিয়তিকাতর এ কোন্ দিন?
বসন্তের নিঃশ্বাস যখন একেবারে আমাদের বুকে এসে পড়ছে,যখন পথে পথে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার বাসকসজ্জায় লেগেছে রক্তের প্লাবন,যখন জম্বুদ্বীপের প্রতিটি নারকেল বনের শীর্ষে হাওয়ার বাসনা জেগে উঠেছে,শতাব্দীপ্রাচীন খিলান ভেদ করে নালন্দায় উঠছে বৃন্দাবনের কৃষ্ণসুর,তখন হঠাৎ একটা বিষাক্ত অজগর কোথা থেকে যে তেড়ে এসে তার ভীষণ নিঃশ্বাসে আমাদের টেনে নিতে শুরু করল,আমরা প্রথমে ততটা বুঝি নি।যখন বুঝলাম ততক্ষণে তার বিশাল হাঁয়ের মধ্যে ঢুকে গেছি।হঠাৎ করেই একদিন রাতারাতি স্কুলের খাতা শেষ করতে হল।স্কুল বন্ধ হল।বাজার,দোকান সব একদিন বন্ধ হয়ে গেল।ছোটো থেকে একদিন বনধ্ হলে বেশ লাগত।রাজনীতি কোনো কালে প্রিয় বিষয় নয়।বাবার সঙ্গে বাগান আর ছাদে ঘুরে কোথা থেকে চোখের পলকে দিন চলে যেত,বুঝতেই পারতাম না।কিন্তু এ তো যেন অনন্তকালের বনধ্।চারদিক খাঁ খাঁ করছে।জীবন স্তব্ধ।সারাদিন বাড়িতে বন্দী হরিণীর মতো এ ঘর ও ঘর।সত্যি যদি কস্তুরী মৃগ হতাম!আপন গন্ধের বিহ্বলতাও অন্ততঃ কিছুটা আশ্বাস দিত।এ যে একেবারে খাঁচায় বন্দী।দিন দিন মৃত্যুর খবর আসে।মুষড়ে পড়ি।যন্ত্রণা জাগে।মনে হয়,নিজের মৃত্যুর বিনিময়ে প্রিয়জন বাঁচুক।শান্তি নেই,আশ্বাস নেই।অথচ প্রকৃতিতে তো কোনো পরিবর্তন নেই।করোনার বিশাল হাঁয়ের মধ্যে প্রকৃতি একটুও ঢোকে নি।অথবা প্রকৃতিই সে করোনা।প্রকৃতির প্রতিশোধই করোনা।
সকাল সকাল তেমন করেই অদ্ভুত সেই পাখিটা আমার জানলায় ঠুকরে দেয়।যতক্ষণ আমি না জাগি,জানলা না খুলি,সে যায় না।পাশের বাড়ির রঙ্গনথোকা নববধূর মতো রক্তিম হয়ে ফুটে থাকে।আমের বোলের গন্ধে ভ্রমর আর প্রজাপতি দলে দলে এসে জোটে।গুলমোহরের বনে বীণার গুঞ্জরণে কোন্ অজানা রাজার ব্যথিত দীর্ঘশ্বাসে রানি কমলিকার মিলনক্ষণ ঘনিয়ে আসে।কিন্তু হায়,মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিলন কবে আবার হবে?কবে রামগিরির যক্ষ পূর্ব মেঘের সব বিষণ্নতা কাটিয়ে উত্তর মেঘের অলকাপুরীতে ঢুকে যাবে,কবে,সে কবে!
আমার অবস্হা এখন 'শরীরিণী বিরহব্যথেব'।এত দুঃখ,এত বিরহ বুঝি আগে কখনো এমন ভাবে বুঝি নি।আগের বিরহ ছিল মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরহ।আগের বিরহ ছিল প্রিয় মানুষের বিরহ।আজকের বিরহ জগৎ-বিরহ।গোটা জগতের সঙ্গে আমি মিলিত হতে চাই।পারছি না।কোন্ অদৃশ্য রাজা নগরের সব দ্বার রুদ্ধ করে আমায় বলেছে এই অন্ধ আর বন্ধতাই আমার নিয়তি।স্কুলে পাশে বসা অনিন্দ্যসুন্দরী অনিন্দ্যা নামে মেয়েটি হঠাৎ এরই মাঝে নেই হয়ে গেল।করোনায়?কে জানে।
মন্দির,মসজিদ,নাগরিকত্ব ছাড়া যখন কিছু লোকের আর বিনোদন ছিল না,তখন কোথা থেকে একটা ঝড় এসে বুঝিয়ে দিল,বেঁচে থাকলে তবেই মন্দির মসজিদ আর নাগরিক আইন।
দুঃখ যখন গোটা জগৎকে জড়িয়ে ফেলে,যখন বুঝি সহজে নিস্তার নেই,তখন আজীবনের বন্ধু কবিতাকে আরো জড়িয়ে ধরি।তেমন গভীর জড়ানোর একটা কুফল হল ধারাবাহিকভাবে কাব্য সৃষ্টির অভিনিবেশ আর থাকে না।সমস্ত সত্তায় একটা ঘোর লাগে।দিনরাতের প্রতিটা মুহূর্ত মনে হয়,এই ডুবে থাকা ছাড়া উপায় নেই।সিরিয়াস সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা নেই।শুধু যেন সময়কে এগিয়ে দেওয়া।লিখি কিন্তু লেখায় তাগিদ নেই।একটা ভেতর কুরে খাওয়া যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠি।মেয়ের দিকে তাকাই।ও বন্ধুর সঙ্গে জোর করে বেরয়।যতক্ষণ না ফেরে নিঃশ্বাস নিতে পারি না ঠিক ভাবে।বাজারে যাই।জমজমাট বাজার টিমটিম করছে।মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবধান এক মিটার।কেউ কারো বাড়িতে আসে না।মাস্কের আড়ালে অদৃশ্য হয় মানুষের সবচেয়ে মধুর অঙ্গ ঠোঁট।দুটি চোখের ভাষাই এখন মুখের ভাষা।চোখগুলিও ভীত,স্তিমিত।সবাই সবাইকে পরিহার করছে।সবাই সবাইকে অবিশ্বাস করছে।সামান্য কাশলেই পাশের বাড়ির লোক সন্দেহে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে।এরই মাঝে সন্ধ্যায় বারান্দায় বসি।আকাশে ক্বচিৎ মেঘের আনাগোনা।কালো বুকের মাঝে তার সাদা বিদ্যুতের তরবারি কে বিঁধে দেয়।কড়কড় করে বাজ পড়ে।প্রবল হাওয়া দিতে থাকে মাঝরাতে।সামনের বাড়ির বাগান থেকে গন্ধরাজের আকুল গন্ধ আসে।আকাশে আধখানা চাঁদ মলিন হাসে।তারই মধ্যে অদূরে বাড়িটির খোলা জানলা দিয়ে একটি সাত বছরের ফুটফুটে ছেলের আঁ আঁ শব্দ রাতের বাতাসে কান্নার মতো মিশে যায়।ছেলেটি মূক ও বধির।সে এসব করোনা,লকডাউন কিছুই বোঝে না।ঈশ্বর তাকে অস্বাভাবিক করে এমন দুর্দিনে স্বাভাবিক হবার অধিকার দিয়েছে।জীবনের কী অদ্ভুত পরিহাস!
রাত আরো বাড়ে।নিশীথের সমস্ত দুঃখের তপস্যা জড়ো করে খুলে বসি মপাসাঁ।ফরাসী বনের হাওয়ায় হাওয়ায় আজ কেবল করোনার গন্ধ।জুলি রোমেনের বয়স হয়।তার পাথরের বাড়ির গায়ে লতানে গোলাপের ঝাড় তাকে আজো উন্মাদ করে।'দ্য মাস্ক' গল্পটা মনে পড়ে।মিল অমিল মিশে যায়।মেপল্ পাতার কমলায় রোদের ছায়া পড়ে।শেন নদীর বুকে কল্লোল ওঠে,'এসো আমার ঘরে এসো।'কেউ আসে না।মানুষ আজ কেবল তার নিজের ঘরে।প্রেম,কামনা,বাসনা আজ সবই কেবল ঘরের।প্রকৃতিতে তার মুক্তি রুদ্ধ।বঙ্কিমের নবকুমারের মতো আমিও আর্তনাদ করি,সুন্দরকে ধরে রাখার।পারি না।শরদিন্দুর 'চন্দনমূর্তি'র সেই বৌদ্ধ শ্রমণের মতো মহাপ্রার্থিতর সামনে দাঁড়িয়ে মহাপ্রলয়ে শেষ হয়ে যাওয়াই কি মানবভাগ্য?মানতে পারি না।এত সুন্দর পৃথিবী।এত সহজে কি সে মানবজাতিকে পুরো শেষ করতে পারে?মানুষই না থাকলে তার সৌন্দর্য দেখবে কে?নিজের স্বার্থেই সে মানুষকে শাস্তি দেবে,আবার নিরাময়ও দেবে।আনন্দ থেকে যদি এ পৃথিবী তৈরি হয়,এক বসন্তের রুদ্র বিফলতায় সে শেষ হয়?কখনোই নয়!
Comments
Post a Comment