শুভদীপ সেনশর্মা

সন্ধান একটা আশ্চর্য কাজ : সেন বংশের ইতিহাস 


এই লকডাউনের সময় আমার ঘরের প্রায় পুরোটা একটু পরিষ্কার করে নিলাম। পরিষ্কার করতে করতে এমন কিছু পুরোনো পত্র-পত্রিকা পেয়েছি যা আমার সংগ্রহে অতি মুল্যবান। কিন্তু এরই মাঝে আমি এমন একটি বই হাতে পেয়েছি যা আমার ধ্যান-ধারনা কে অনেকটা ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমার পরিবাবরের বংশপত্র। সেন বংশের ৮১০ বছরের ইতিহাস। প্রসঙ্গত জানাই এই সেন বংশের সাথে লক্ষণ সেন বা বল্লাল সেনের কোনো যোগ নেই। এই সেন বংশ সম্পূর্ণ আলাদা। বৈদ্য ব্রাহ্মণের বংশ এই সেন বংশ। যাক্ গে ইতিহাসে আসি। পত্র মারফৎ যা জানলাম তা খানিকটা লিখছি। 

যে সময়ের কথা প্রথম পেলাম তখন বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ তিলকচাঁদ মহ্তাব বাহাদুরের রাজত্বকাল। প্রায় ১১৫০ বঙ্গাব্দ হবে। আমাদের পূর্ব পুরুষ ছিলেন উদয়রাম সেন।  ১১৬৭-১১৭৭ বঙ্গাব্দ অব্দি তিনি ছিলেন বর্ধমানের রাজ-কবিরাজ। সেসময় আমাদের পূর্ব পুরুষের বসবাস ছিল বর্ধমানের নাদনঘাটের কাছে জামনা গ্রামে। বলে রাখি, উদয়রাম মহারাজা তিলকচাঁদের খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন। বর্ধমান রাজ্যের সব থেকে বড়ো কবিরাজ ছিলেন সেসময়। 

১২০৭ বঙ্গাব্দ উদয়রাম অবসর নেন। এরপর একদিন জলপথে তিনি উদয়রাম কাটোয়ার পাশে কোনো এক গ্রামে রোগী দেখতে আসেন। ফেরার পথে তাঁর চোখে পরে বিল্বেশ্বর গ্রামটি। গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি সেই মুহুর্তে ঠিক করেন এই গ্রামে বসতি স্থাপন করবেন। সম্ভবত ১২১০ বঙ্গাব্দ নাগাদ কাটোয়ার বিল্বেশ্বর গ্রামে বিশাল এক প্রাসাদ নির্মাণ করেন কবিরাজ উদয়রাম সেন। তখন বিল্বেশ্বরে উদয়রাম ছাড়া আর কোনো বসতিই ছিল না। বংশপঞ্জী থেকে জানতে পারলাম বর্ধমান মহারাজ উদয়রামকে বিল্বেশ্বর প্রায় অর্ধেক অংশ দিয়েছিলেন। তবে বর্তমানে সেই প্রাসাদের অধিকাংশ নদীর গর্ভে।

এই সমস্ত ইতিহাসটির প্রমাণ স্বরূপ আছে একটি বহু প্রাচীন দলিল। মহারাজ তিলকচাঁদের একটি চিঠি এবং ১২০৭ বঙ্গাব্দ শ্রীনটবর দাশ এবং শ্রীবিন্দাবন দত্ত (বানানটি এমনই লেখা) কে লিখিত একটি ঋণপত্র। এই ঋণপত্রে উল্লেখ আছে,  এই দুই ব্যক্তি কবিরাজ উদয়রাম সেনের কাছে ৬৪ সিকি ধার নিয়েছিলেন। এবং এই চিঠিতে সাক্ষী ছিলেন বর্ধমান মহারাজের একজন কর্মচারী। নাম শ্রীগুরুচরন দাশ কৈবর্ত্ত। প্রসঙ্গত জানাই এই বংশপঞ্জীতে শুধুমাত্র এই একটি চিঠিই ছাপা হয়েছে। দাদুর কাছে শুনেছি বাকি প্রমাণপত্র সব গ্রামের বাড়িতে একটি চোরা কুঠুরিতে রাখা আছে, যার তথ্য পরিবারের কেউ জানেন না। শুধুমাত্র এই একটি চিঠি কোনোভাবে সামনে চলে আসে। সম্ভবত চোরা কুঠুরিতে এই চিঠি রাখাই হয়নি। যেহেতু এটি একটি ঋণপত্র সেহেতু এটিকে সামনে কোথাও রাখা হয়েছিল। 

আমি এই বংশের ১৭ তম পুরুষ। পরিবারের ইতিহাস ধরলে বংশ তেত্রিশ পুরুষের। কিন্তু তথ্য পেয়েছি শুধুমাত্র ১৭ পুরুষের। আমাদের পুরুষ বিভাজন খাননিকটা এরকম : শশধর সেন > বিনায়ক সেন > গজপতি সেন > রামভদ্র সেন > রামদেব সেন > বৈকুণ্ঠরাম সেন > উদয়রাম সেন > রামমোহন সেন > রামযাদব সেন > সীতানাথ সেন > হরিপদ সেন > কৃষ্ণধন সেন > লোকনাথ সেন > কালীপদ সেন > রবীন্দ্রনাথ সেন > প্রবীর সেন > শুভদীপ সেন। আমাদের বংশের পদবি সেন, সেনগুপ্ত, দাশ, দাশগুপ্ত, দাশশর্মা, সেনশর্মা, মল্লিক প্রমুখ। ১২তম পুরুষ থেকে আমাদের পদবি হিসাবে 'সেনশর্মা' ব্যবহার হচ্ছে। শশধর সেনেরও আগে আমাদের পদবি ছিল সেন গোস্বামী। 

আমার দাদুর বাবা, মানে আমার বাবার দাদু অর্থাৎ আমার বড়োবাবা কবিরাজ কালীপদ সেনশর্মা যৌবন বয়সে কাটোয়ায় চলে আসেন। সে সময় কাটোয়া শহরের দুইজন ডাক্তার ছিলেন। একজন চিলেন কবিরাজ কালীপদ সেনশর্মা এবং অন্যজন হোমিওপ্যাথ ডাঃ বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়। দাদুর বয়স তখন ৫ বছর। দাদুর কাছে ছোটবেলায় শুনেছি সেইসময় আমাদের ৩টি ঘোড়ার গাড়ী ছিল। আমার বাবা,কাকা যে বাড়িতে বড়ে হয়েছেন সেই বাড়ির বয়স ছিল প্রায় ১৫০-২০০ বছর। সেই বাড়িও ছিল একটা প্রাসাদের মতো। নাচঘর ছিল। শোভাদালান ছিল। বিশাল ইঁদারা ছিল। গুপ্ত কুঠুরি ছিল। আমি সেসমব দেখেছি। তবে ভগ্নাবশেষ। আমারও শৈশব কেটেছে সে বাড়িতে। ২০০৭ সালে আমার ঠাকুমা প্রয়াত হবার পর ২০০৮ সালে বারি বিক্রি হয়ে যায়। আমার কাকা সুবীর সেনশর্মা চলে যান চন্দননগর। সেখানেই পাকাপাকি বসবাস শুরু। কাকা বর্তমানে কলকাতায় একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। আর আমার বাবা প্রবীর সেনশর্মা, মানে আমরা চলে আসি শহরের প্রান্তে একটি পাড়ায়। বর্তমানে আমাদের বাড়ি এখানেই। বাবা একটি পাবলিক স্কুলের আঁকার শিক্ষক এবং মা সরকারি চাকরি করেন। আমার দাদুর বয়স বর্তমানে ৯৫ বছর। কত ইতিহাসের সাক্ষী আমার দাদু নিজেই। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুভাষচন্দ্র, স্বাধীনতা, দেশভাগ সমস্ত ইতিহাস চাক্ষুষ করেছেন। কত গল্প শুনেছি। 

আমি এই বংশলতিকা পেয়েছি আমার জেঠু, যিনি আমার সাহিত্যগুরুও ছিলেন, তিনি শিশুসাহিত্যিক, সবাইরাজা পত্রিকার সম্পাদক শ্রীবিবেকানন্দ সেনগুপ্ত'র কাছ থেকে। 

এই লকডাউনের সময় অঢেল সময় পেয়েছি হাতে। যখন এইসব ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম একটা অসম্ভব উল্লাস হচ্ছিল ভেতর ভেতর। একটা বংশের ১৭ পুরুষের নাম জানাটা বিশাল বড়ে একটা ব্যাপার। তারপরে আবার যেখানে ৮১০ বছরের ইতিহাস সম্বলিত একটি বংশ। 









ছবি ও লেখার কপিরাইট : শুভদীপ সেনশর্মা

Comments

পাঠকের পছন্দ