গৌরব চক্রবর্তী
আমার অরক্ষিত কোয়ারেন্টাইন
প্রিয় ফুল,
প্রিয়তম এই ধ্বনিটির পাশে তোমার এইসব শব্দারোপিত বিস্ময় নিয়েই আমি জেগে বসে আছি অনন্তকাল! শতাব্দী তো একটা খণ্ড সময়চিত্র! তার বাইরে-- এপারে ওপারে ছড়িয়ে রয়েছে, জড়িয়ে রয়েছে আরও কত অন্তহীন মায়া! সেই মায়াগুলোর ভাগ চাও না? সেই মায়াগুলোর স্বাদ চেখে নিতে সাধ হয় না তোমার? মাত্র এক শতাব্দীই কাফি হয়ে থাকবে তোমার, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে?
এমনিতেই আজ এখন এই মুহূর্তগুলো বড় অনিশ্চয়তার ভাঁজে বন্দি! কে কতক্ষণ আছি, কে নেই বা থাকব না বেশিক্ষণ-- এসবের কতটুকু জানি! মাস ঘুরতে চলল প্রায় এখনও লকডাউন। রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, এয়ারপোর্ট, বাসটার্মিনাল সব ফাঁকা-- খালি-- অনন্ত শূন্যতায় ভরা। কোনও ব্যস্ততার অছিলা নেই। ইঁদুরদৌড়ের তৎপরতা নেই। এ ওকে, সে তাকে, অমুক তমুককে পেরিয়ে বা পার করে জিতে যাওয়ার, উত্তির্ন হয়ে যাওয়ার ফন্দিফিকির নেই। ছুটোছুটি নেই। হুটোপুটি নেই৷ তাড়াহুড়ো মেই। আজ যে কোনও তৃতীয় বিশ্বের একটি প্রান্তিক জনপদও প্রথম বিশ্বের হাইরাইজ বিল্ডিংগুলোর সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া জাতীয় সড়কের থেকে নিয়তিগত ভাবে আলাদা নয়। সারা বিশ্বজুড়ে এই মৃত্যুভয়। সারা বিশ্বজুড়ে এই আতঙ্কিত হাওয়া। সারা বিশ্বজুড়ে এই বাঁচার লড়াই, অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। কে কাকে আজ দেখছে অথচ কাল আর দেখতে পাবে না-- এই নিয়ে এরকম একটা বিবর্ণ সংশয়। কতখানি আছি আমরা? কতটুকু আছি আর?
কথার দেওয়া না-দেওয়ায় এসে যায় না হয়ত কিছু! কিন্তু ফুল, ভেবে দেখো, এই কথাগুলোর থাকা না-থাকায় আমাদের কত কিছু এসে যায় প্রতিমুহূর্তে! এই যে ছাতিমের গন্ধ, এই যে জীবনের স্রোত-- যার কাছে আমি অবলীলায় আত্মসমর্পণ করেই বসে আছি, সেই স্রোত তো তুমি ছাড়া আর কেউ নয়! তুমি কি শুধুই তুমি? তুমি কি আমি-ও নয় আরেকটা? আমি কি তোমার আরেকটা তুমি নই? তুমি যথার্থই বাস্তবিক মানুষ হয়ত, ঠিকই-- তা বলে তুমি কি পারো না তোমার এই বাস্তবিকতা দিয়ে আমার কল্পনাগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকতে খানিক? আমার কল্পনার ভেতরে ছড়িয়ে থাকা লাগামহীন এইসব নাছোড়বান্দা রঙগুলোর ঠোঁটে একবার চুমুক দিয়ে সমর্পণের প্রসাদ বানিয়ে দিতে, পারো না? সেই প্রসাদ যাতে আমি সারাজীবন ধরে, এমনকি জীবনের শেষে হাওয়ায় ভাসতে থাকা অতিজীবনেও আস্বাদ করে সম্পূর্ণ হতে পারি! আমি-আমরার তফাৎ নেই কোনও! নেইই! কিন্তু আমি-র ভেতরে আমাদের 'আমরা' যেন নিষিক্ত হয়ে আছে আমাদের জন্মের আগে থেকে! আমি মানেই তো তুমি! আর তুমি মানেই প্রশ্নাতীত ভাবে আমিই! তবু... আমরা শব্দটি কেন বললাম, জানো? আসলে এই আমি বা তুমি শুধুমাত্র আমার আর তোমার ভেতরে সীমাবদ্ধ যে নেই -- সে তো আমাদের চিন্তা-চেতনাকে অতিক্রম করে আমাদের পারিপার্শ্বিক, সময়কাল ও আমাদের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এরা সবাই মিলেই আমরা। এরা সবাই একেকটা আমি ও তুমি! আমার গোটা জীবন আজ তাই এক অত্যাবশ্যক সুগন্ধে ভরে আছে! ছেয়ে আছে আমার চিন্তাচেতনায়। আমাদের কথা হওয়া না-হওয়া, দেখা হওয়া না-হওয়ার মধ্যে আসলে যে কোনও ব্যবধান নেই! কারণ, এই যে বললাম, আমি আর তুমি আলাদাই নই-- আমার ভেতরেই তুমি আর তোমার ভেতরেই তো আমি! এবার বলো, আমি কি তফাৎ করেছি?
হ্যাঁ, আমি বড় অগোছালো... আবার তুমি সব গোছাতে গোছাতে আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলেছ সেই ভালোবাসার মোহনারই দিকে! কারণ, একটু আগেই যে বললাম তুমিই সেই স্রোত! সেই বয়ে চলা নদী তো তুমিই! আর আমাদের উৎস ও মোহনার মাঝে সমঝোতা হবে বৈকি! রোজ হবে! হওয়াই তো উচিত! সমঝোতা হয় কেন জানো, ফুল? দ্বন্দ্ব থাকলে। এই দ্বন্দ্ব আছে বলেই তো দেশলাইয়ের বারুদ-কাঠি মসৃণ তলে ঘষলে স্ফুলিঙ্গ জন্মায় না আগুনের-- তার জন্য দেশলাই-বাক্সের গায়ে বারুদের অমসৃণ তলও লাগে! অর্থাৎ দ্বন্দ্ব লাগে একটা! এই দ্বন্দ্ব আছে বলেই সংসার এত মায়াময়, এত এত নতুন প্রতিদিন! এই দ্বন্দ্ব আছে বলেই তো তোমাকে রোজ আবিষ্কারের নেশা থেকে অব্যাহতি পাই না আমি আর তুমিও ফুরিয়ে যাও না কখনও আমার ভেতর থেকে! যদি বেঁচে থাকি, না-ই বা থাকি যদিও… তবু দেখবে এই অমীমাংসিত বেলায় কোথাও না কোথাও
তোমার নামের পাশে দীর্ঘচুম্বন
আলো রেখে গেছে...
Comments
Post a Comment