বিতান চক্রবর্তী

রোদের ভয়




খাঁ-খাঁ করছে দুপুরটা। কতদিন পর এমন একটা দুপুরে পাড়ার রাস্তায় আমি, ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। স্রোতের তোড়ে কত দৃশ্যই না ভেসে যায়, সব দেখা যায় কি? তেমনই এতদিন এই আনমনে পড়ে থাকা দৃশ্যগুলোকে চোখেই পড়েনি। অথচ এ-তো প্রতিদিন আমার চারপাশেই বয়ে গেছে। আমি বাইরে এসে দাঁড়াতেই পাড়ার দুটো কুকুর লেজ নাড়তে নাড়তে কাছে এলো। একটা বাদামি আর একটা কালো। কালোটা নতুন আমদানি পাড়ায়। বছর দুয়েক ধরে দেখছি। বাদামিটার জন্ম আমার চোখের সামনে, আমার বাড়ির পেছনের ঘুপচি ঘরে। বেশ কয়েকমাস আমার হাতে খেয়েওছে। একটা নাম দিয়েছিলাম ওর, কী যেন! ঠিক মনে পড়ছে না। অনেকদিন হয়ে গেল ওকে নাম ধরে ডাকি না। অথচ ও ঠিক আমাকে মনে রেখেছে। যেমন মনে রেখেছে এই দুপুরের রোদ। সত্যি বলতে কী, প্রকৃতির যে কোনো কণার মধ্যে যদি আপনি আপনার কিছু রেখে যান, ভুল করে হলেও, তাহলে সে আপনাকে ঠিক মনে রাখবে। এই যে দুপুরগুলো, ষোলো-সতেরো বছর আগে স্কুলের জানলা দিয়েও তো আসত! তার কাছে কত না রঙিন কল্পনা আমরা রেখে দিয়েছিলাম, আর আজ ঠিক সে এসেছে ফেরত দিয়ে যেতে। বা এই বাদামি রঙের কুকুরটা। ওর কাছেও আমার কিছু ভালোবাসার ঋণ থেকে গিয়েছিল হয়তো… আজ ওর নতুন একটা নাম দিলাম, জিনিয়া।

কোয়ারান্টিন পর্ব না চললে, বিস্তারে দেখার অবসরটুকু কার-ই ছিল? নিজেদের ভেতর যে অখণ্ড ঘর তুলে আমরা তাকে নিয়ন আলোয় সাজাতে ব্যস্ত ছিলাম তা বন্ধ করাতেই না এমন রোদ এসে লাগল চোখে! না-হলে ঘরে যে জানলা বলে একটা বস্তু আছে তাই ভুলে গিয়েছিলাম আমরা। এই নতুন করে এসে-লাগা বাতাসে বৈশাখের আবহ থাকলেও, আরাম পাই। যে বাতাস ছুঁয়ে দেয়, আমাকে, সে ছুঁয়ে আসে আমার প্রিয়জনকে, তা আবার মনে করায় এমন দুপুরই। সমস্তকে ছুঁয়েই তো আছি— এই আলো, এই বাতাস, এই নৈঃশব্দ ফিরে-ফিরে আসে আমাদের কাছে। যা কিছু রেখে যাবেন আপনি আনমনে, প্রকৃতি ফেরত দিয়ে যাবে সময় মতন। তবে সে তো আর ঘণ্টি বাজাতে পারে না, সে ফেলে ফেলে যাবে, আমাদের কুড়িয়ে নিতে হবে। কিন্তু কুড়িয়ে রাখব কোথায়? ঘর যে ভর্তি! পুরস্কার, অভিমান, অহংকার… কাকে রেখে কাকে ফেলা যায়? এ বড়ো কঠিন সিদ্ধান্ত। কোনটা যে অপ্রয়োজনীয় সেটুকু শেখার জন্য কি এই বেয়াল্লিশ দিন যথেষ্ট?

কালো কুকুরটা খুব একটা আমার কাছে ঘেঁষে না। আমি ডাকি, ও তাকায়, সন্দহের চোখে লেজ নড়ায়, কিন্তু কাছে আসে না। আমি কি এগোব? যদি কামড়ে দেয়?

আজকাল কিছু সিদ্ধান্ত নিতে গেলে প্রথমেই দশ পাতার একটা চিন্তা মাথায় চাপে। যেমন একলা ডুবন্ত জাহাজকে পাড়ে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত ফন্দি কষে ফেলতে হয়, তেমনই। বহুদিনের কোনো বন্ধু, স্বল্প-পরিচিত, ফোন করলে মাথাতে একটা ডিটেকটর চালু হয়ে যায়। খুঁজে দেখে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় নাকি! তারপর বাকি কথার জন্য ছাড়পত্র। ধরে নেওয়া যাক আগামী চোদ্দ দিনের (যে-দিন এ লেখা আমি লিখছি সেদিন থেকে) পর আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনের দিকে এগোলাম, এবারের ডিটেকটরগুলো কি আরও সাবধানী হয়ে উঠবে? আচ্ছা, আমরা কি ফুল কিনে নিয়ে যেতে পারব প্রেমিকার কাছে? সে নেবে? নাকি বলবে, “ওখানে রাখো, স্যানিটাইজ করে নিই আগে।” শুনছি একটা নতুন পৃথিবীতে আমরা ঢুকছি। এখানে অনেক কিছু বদলে যাবে। সেখানে মানিয়ে নিতে হবে। চোখে পড়বে এই নতুন পৃথিবীর বদল? আমি জীবনে দুটো পৃথিবী-বদল দেখেছি। একটা নন-ডিজিটাল পৃথিবী মানে পিসিও বুথের পৃথিবী, আর একটা ডিজিটাল। ৫০১ টাকার মোবাইল থেকে 4G স্পিড। এই পরিবর্তন খুব কি মনে আছে আমার? কতটা আলাদা জীবন কাটিয়েছি। কতটা পালটেছে। আবার একটা নতুন পৃথিবী। বদলের চিন্তা নেই। চিন্তা এই প্রতি মুহূর্তের একটু একটু করে পালটে যাওয়ার সাক্ষী থাকতে পারি কি আমরা? যেমন ধরুন, এই কয়েক মিনিটেই রোদটা আরও যে একটু পশ্চিমে ঢলে গেল, সামনের বাতাবি গাছটার পশ্চিমদিকের লেবুগুলোও এবার চকচক করে উঠল, চোখে পড়ল কি? ঘরে ঢুকে চোখে এলো দরজার একটা জায়গায় রং ক্ষয়ে গেছে, শীতে আবার রং করাতে হবে। না-হলে সে ক্রমশ বেরঙিন হয়ে গিয়ে ফ্যাকাসে মুখে প্রতিদিন আমাকে অভ্যর্থনা জানাবে।

আরও একটা ভয় আমাদের সঙ্গী হল এবার। ভয় রোগের নয়, জীবনের। জীবন আছে বলেই না ভয়! ভয়, আমাদের বাহ্যিক আদপ-কায়দা বদলাবে, কিন্ত ভেতরের চোখ খুলবে কি? মুখ ঢাকা থাকবে সুতির কাপড়ে, কিন্তু ভেতরের পর্দা— সে তো ভারী, রোদ আটকানো মোটা কাপড়ের। তাকে পাতলা করবার সময়টুকু কি পেলাম এই বেয়াল্লিশ দিনে? যে-দিন রাতে ঘরে থাকাটাই শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা হল, পাশের বাড়ির খবর নেওয়ার সময়টুকু ছিল কি আমাদের? নাকি লাইন বাড়িয়ে, বাছাই সম্পদটুকু তুলে আনার প্রতিযোগিতায় সময় গিয়েছে? আজ যখন সময় আছে খানিক তাই প্রশ্নগুলো করে রাখি নিজেকে, কী জানি, নতুন পৃথিবীতে এত সময় পাব কিনা!

Comments

পাঠকের পছন্দ