সোনালী ঘোষ

বড় দীর্ঘ এ অপেক্ষা



এখন অনেক রাত। স্বপ্নহীন একা নিস্তব্ধ একটা রাত।জানুয়ারিতে থেকে শুনছিলাম চীনে কোভিড 19 আক্রান্তের খবর। তেমন ভাবে পাত্তা দেই নি. চিন অনেক দূর। উহানের তেমন নাম ডাক ও নেই সেখান থেকে এই কোলকাতায় কিভাবে ভাইরাস আসবে? মশগুল ছিলাম বই মেলার চেনা অচেনা ছন্দে, শীতের মখমলী রোদ, কমলালেবুর সাজানো বিকেল আরো কত কি। আমি ছাত্র ছাত্রীদের সাথে নতুন বছরের প্ল‍্যান করছি এবার ডস্টিনেশন হবে বাঁকুড়ার লালপাহাড়িয়া, পলাশের লাল আদর মাখব আর স্বপ্নের পুরুষের কাঁধে মাথা রেখে গুনগুন, জ‍্যোৎস্না গলা রাত, সারারাত মন কেমনিয়া বাঁশির সুর। আদিবাসীদের পৃথিবীতে
সব ক্লান্তি খুলে রাখব,রাতভোর ডুবে থাকব তার চোখের গভীরে, সব অসুখ সেরে যাবে, ব‍্যস্ততা র  ক্ষতে খানিকটা উপশম হবে।
হঠাৎই সব পালটাতে শুরু করে চেনা পরিবেশ।চারদিক বড় কোলাহল, পৃথিবীতে মরণ রোগ থাবা বসিয়েছে চীন, ইতালি, ইরান, স্পেন,একে একে কফিনের মিছিল।ট্রাকে ট্রাকে থরেথরে লাশেদের ভীড়। পরিজনহীন প্লাস্টিকে মোড়া প্রিয় জন। একে একে সোস‍্যাল সাইটে আতঙ্কিত মুখ, বাঁচার আকুল আর্তি, আর্তি পায়ে বেড়ি পর একা একাই, ঘরে হতে হবে বন্দী। বিশ্বের তাবড় উন্নাসিক দেশ উদ্ভ্রান্ত। ইতালির মত দেশ, স্পেনের মত দেশ তো প্রথমে পাত্তাই দেয় নি।ভেবেছিল সামলে নেবে কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।কেমন দুনিয়াটা দৌড়ে গেল। স্বপ্নের নগরী ইতালী মৃত্যু পুরীতে পরিণত, বেলজিয়ামের কাচেও চিড়, স্প‍্যনিশ আর্মাডার মত গুঁড়গয়ে গেলো স্পেনের অহংকার, ইংল‍্যান্ডের রাজপরিবারের ও করোনা হামলে পরল, টালমাটাল হল ইংল‍্যান্ডের মাটি।আমেরিকা দেখল মৃত্যু মিছিল, পায়ের নিচের মাটি ধ্বসতে শুরু করল। এদিকে ভারত সরকার ২২শে মার্চ"জনতা কারফিউ" তারপর লকডাউন। গোটা দেশ মুড়ে গেল , ট্রেনের চাকা স্তব্ধ হয়ে গেল
উড়ান ভরে এল প্রবাসী। সাথে আনল কোভিড 19।আর সরকারের দৃষ্টি ঘোরাতে প‍্যারাসিটামল খেয়ে প্লেন থেকে দেশের মাটিতে পা রাখলেন।বিদেশি জীবানুতে বিপর্যস্ত হল দেশ। এ দিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার আকুল আর্তি । তাদের স‍্যানিটাইজিং পদ্ধতি দেখে হতবম্ভ হলাম।আমরা দেখলাম শিক্ষিত মানসিকতার পচন, ছড়িয়ে দিল আমার চৈত্রে ,মারণ ঢেউ। "আমার সর্বনাশ" অর্থাৎ এদেশের সর্বনাশ লেখা হল। অদৃশ্য জীবানু কোভিড 19  অজান্তেই শরীরের ভেতর বাসা করছে। বড্ড ছোঁয়াচে সে ।তারপর যে হাতগুলো এতদিন ছুঁয়ে ছিল, দূরে সরতে লাগল, যে মুখ আমার বাঁচার রসদ ঝাপসা হতে থাকল, মুখ ঢেকে গেল মুখোশে, বাতাসে সংক্রমণ।হাহাকারে কান পাতা দায়।সারাক্ষণ স‍্যানিটাইজিং। ঘরের কোনে নিক্ষিপ্ত হলাম। মেরুদন্ডে মনে হল কেউ যেনো দলাদলা বরফ ছেড়েছে। সব প্রিয়জনের মুখ ভেসে উঠল, শূণ‍্য হল দৃষ্টি। শুধু বুকের কাছে ছোট্ট সোনামুখী আমার কন‍্যে। সচরাচর কাজের ব‍্যস্ততার কারণে ওকে কাছে পাই নে, নতুন করে ওকে চিনলাম, সাথে চিনলাম প্রকৃতিকে। চিড়িয়াখানায় যেমন আমরা বেঁধেছি পশুদের, আর প্রকৃতির সন্তানদের বিলুপ্তির ঘরে পাঠিয়েছি , তেমনি আজ প্রকৃতি যেন প্রতিশোধ স্পৃহ। দেখা যায় না এমন এক শত্রু আমাদের ঘরের ভেতর বন্দী করেছে। অন‍্যদিকে দেখলাম বোম্বে র রাস্তায় ময়ূর, আমাদের সামনের মাঠেই তো নাম না জানা পাখি ঘুরছে, বাতাস দূষণ হীন প্রকৃতি সেরে উঠছে।আর আমরা নিজেদের কবর আগেই খুঁড়েছি শুধু কিনারে দাঁড়িয়ে।কত লক্ষ মানুষের হাহাকার, বাঁচার মৌলিক পথ রুদ্ধ , কত মা তার চোখের জল ফেলছে সন্তানের মুখে খাবার জোটাতে পারছে না। এদেশে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো খুব খারাপ কোভিড আক্রান্ত ব‍্যক্তি চিকিৎসা হবে কি করে? তারপরেও আছে অজ্ঞতা। প্রথম বিশ্বের দেশগুলো ই মুথ থুবরে পড়েছে, এর মধ্যেও রাজনৈতিক তরজা অব‍্যাহত।ত্রাণ নিয়ে দরকষাকষি, ট্রাম্পের হুমকি ওষুধ নিয়ে আরো কত ঘটনা ,একের পর এক ঘটনা বেবাক করছে বিশ্বকে। আমরা কি তবে বিলোপের দিকে? আমরা এখনো সচেতন নেই ।তার পর " জান" আর  "জাহানের" এক অদ্ভুত চাকায় পিষ্ট। আমরা এখন চিড়িয়াখানার বন্দী পাখি আকাশ দেখি কিন্তু ডানায় জোর কৈ?কতদিন আর কতদিন? আজ প্রকৃতির কাছে নতজানু ছাড়া উপায় নেই। ফাঁকা রাস্তায় কত স্মৃতি গড়াগড়ি ।এখন অনেক রাত ঘুম আসেনা। ট্রেনের চাকায় শব্দ ওঠে না, প্রিয় মানুষ ফেরার তাড়া নেই আছে কেবল তাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ।সকালে কারখানার সাইরেন নেই, স্কুল কলেজ নেই ট্রাম নেই বাস নেই কাজ নেই, আছে অনিশ্চয়তা অদ্ভুত নিঝুম চারদিক । এক অদৃশ্য ঝড়।
এই ঝড় নিশ্চই থামবে মহামারীর শেষে অদ্ভুত আলোয় তুমি - আমি -আমরা এক নতুন ভোর দেখব। প্রকৃতির আঁচলে লিখব আমাদের নাম একটা নতুন সভ‍্যতার নাম,বিভেদহীন সভ‍্যতার নাম।

Comments

পাঠকের পছন্দ