রিয়া বণিক

আমার কোয়ারেন্টাইন যাপন


 বাড়ি থেকে শেষ বেরিয়েছিলাম ১৬ ই মার্চ, ২০২০। তারিখ টা খুব ভালো করে মনে থাকার কারণ সেদিন সোমবার ছিল, আমার কলেজ যাওয়ার দিন। এখানে একটু সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। আমি রিয়া বণিক, সঙ্গীত নিয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করে বর্তমানে দুটো বেসরকারী বি.এড কলেজে সঙ্গীত বিভাগের  অতিথি অধ্যাপিকা । 
সেদিনটা ছিল আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই কলেজ যাওয়া এবং বাড়ি ফেরা। আমার একটি কলেজ নিউটাউন অঞ্চলে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার মহেশতলায় থাকার সুবাদে আমার বাড়ি ফেরার পথে গড়িয়াহাট এবং লেক মল পরে। তখনো কোলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে করোনার প্রভাব এতটাও পড়েনি। কিন্তু টিভি এবং খবরের কাগজের মাধ্যমে এটুকু সকলেরই কানে পৌঁছেছিল যে করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচতে হলে দূরত্ব বজায় রাখার সাথেই হাতও ধুতে হবে বারবার সাবান অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে। আমিও স্যানিটাইজারের খোঁজে কলেজ থেকে ফেরার পথে লেকমলে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু ততদিনে স্যানিটাইজার অমিল ! 
যাই হোক বাড়ি ফিরে এলাম। পরদিন ভোরেই বেরোনোর কথা ছিল আমার অন্য একটি কলেজের উদ্দেশ্যে, যেটা মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গায় অবস্থিত। কিন্তু বিধি বাম ! কলেজ থেকে সন্ধ্যেয় ফোন করলেন সেক্রেটারি স্যার, এই মুহূর্তে যাতে না যাই কলেজে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টিভি তে ঘোষণা শুনলাম খুব শীঘ্রই গৃহবন্দী হতে হবে সকলকে, দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা হতে চলেছে ! 

প্রতিদিন খবরের কাগজ এবং সংবাদমাধ্যমে দেখতাম আমাদের দেশে এমনকি রাজ্যে ও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে হুহু করে। উদ্বেগ দ্বিগুন হতে থাকলো আর তার সাথেই কাজকর্ম সহ সব কিছু নিয়েই বাড়তে লাগলো অনিশ্চয়তা !

আজ একমাসের বেশি হলো আমি পুরোপুরি গৃহবন্দী। সর্দি কাশির ধাত থাকার কারণে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মেনে বাড়িতেই রয়েছি। এই একমাসে অনেক রকম উপলব্ধি হয়েছে, সবার প্রথম যে বিষয়টি হলো সপ্তাহে দুদিন সকাল ৬ টায় এলার্ম বাজে আমার ফোনে।  কলেজ যাওয়ার জন্যই সেট করা। সেটা এই একমাস যাবৎ বাজছে না। আবার হয়তো বা বাজছে, আমি ঘুমের ঘোরে বন্ধ করে দিচ্ছি! তারিখ, বার এই সব কিছুই মাস খানেক আগেও জীবনের সিকি ভাগ জুড়ে ছিল, আজ এসবের প্রয়োজন ফুরিয়েছে।  সকাল গড়িয়ে দুপুর আবার দুপুর গড়িয়ে বিকেল থেকে রাত হচ্ছে। আবার একটা নতুন দিন এসে পড়ছে, কিন্তু সেই দিনটিকে নতুন বলে তো মনে হচ্ছে না ! গতকালের প্রতিচ্ছবি দেখছি যেন ! চিন্তা বাড়ছে আমার কর্মক্ষেত্র নিয়ে। বেসরকারী বি.এড কলেজে পড়ানোর একধরনের অনিশ্চয়তা আছে। একটি কলেজ থেকে এই মাসে স্যালারি পেয়েছি। আগামীমাসে পাবো কিনা জানিনা। অন্য দিকে বেলডাঙ্গার কলেজ থেকে আমার দুমাসের স্যালারি প্রাপ্য। আমি আসলে চেয়ে উঠতে পারিনা। এই একমাসে কত মানুষ যে কাজ হারিয়েছেন তার হিসেব নেই! আমার ও তেমনি শঙ্কা কাজ করছে, চাকরি থাকবে তো ??

গত ফেব্রুয়ারিতে একটি কলেজ থেকে স্টুডেন্টসদের নিয়ে এক্সকার্শনে গিয়েছিলাম সিকিমে । আজ সেই স্মৃতি গুলো বিস্মৃতির আড়ালে মুখ লুকিয়েছে। মনে হয় যেন কতদিন কোথাও ঘুরতে যাইনি, কতদিন পাহাড় কে ছুঁয়ে দেখিনি! 

সপ্তাহে দুদিন , শনি এবং রবিবার রিহার্সাল এ যেতাম লকডাউনের আগে। তারা অনলাইনে ক্লাস শুরু করলেও আমি যেন তাতে আনন্দ পাইনা।  ভিডিও কলে গান শেখাতে গিয়ে হয়তো গানের কাঠামো তৈরি করে দিতে পারছি, কিন্তু তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে কই ? কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে গান গাইতে গাইতে আমার চোখ জ্বালা করে। আমি গান ভুলে যাই। 

তবে এই অখন্ড অবসর যাপনের কিছু ভালো দিক ও রয়েছে। এখন সকলেই যেহেতু বাড়িতেই আছি, ফলে বাড়িতে থাকা মানুষগুলোর সাথে সম্পর্কগুলো আরো সুদৃঢ় করার সুযোগ পেয়েছি। মা, বাবা, দাদা, বৌদি এবং পুকু ( দাদার ছেলে ) । সকলে মিলে কবে এমন দিনের পর দিন একসাথে কাটিয়েছি মনে পড়েনা। আসলে বাড়িতে থেকে ও বাড়ির মানুষগুলোর সাথে যোগাযোগ কমে যায় এই মেকি ব্যস্ততার দুনিয়ায় ! প্রকৃতি বোধহয় সম্পর্কগুলোকে আরো মজবুত করে নেওয়ার একটা সুযোগ দিলো আমাদের।  যে বন্ধুদের সাথে কালে ভদ্রে এক-আধবার কথা হতো , এখন তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখে, আমিও রাখি।  এমন এক সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে মনের খুব কাছে থাকা মানুষদের আরো অনেক বেশি করে পাশে পেতে ইচ্ছে করছে।  কারণ সত্যিই তো জানিনা এই অদৃশ্য ভাইরাসের হাত থেকে কবে নিষ্কৃতি পাবে এই বিশ্ব! কবে আবার প্রাণখুলে হাসবো, আড্ডা দেবো বন্ধুরা মিলে, ঘুরতে যাবো এই প্রান্ত থেকে সেইপ্রান্ত!

এই গৃহবন্দী পরিস্থিতিকে আমি মানিয়ে নিয়েছি এবং আমি কৃতজ্ঞ এটুকু ভেবেই যে আমায় ফ্রন্টলাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার-নার্সদের মতো করোনার বিরুদ্ধে অদৃশ্য যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে হচ্ছে না । কাল কে কি খাবো ভাবতে হচ্ছে না সেসব কিছু নিয়েও। বাড়ি থেকে বেরোতে পারবো কবে জানিনা। তবে অদ্ভুতভাবে ঘেঁটে গেছে সবটুকু। যতদিন এগোচ্ছে আমি ভুলে যাচ্ছি লকডাউন এর আগে আমার ব্যস্ত জীবনের কথা! আমার হাইপার থাইরয়েড আছে। ডাক্তারবাবু বলেন যতদিন এগোবে আমি ধীরে ধীরে সব কিছুই ভুলতে থাকবো। যতদিন না সব ভুলে যাচ্ছি, ততদিন নাহয় সবার মাঝে থাকি, আরো অনেক বেশি অক্সিজেন জুগিয়ে চলি ভালোবাসার সম্পর্কগুলোকে। 

আমি আত্মবিশ্বাসী একদিন ঠিকই করোনা চলে যাবে। আজকের এই অন্ধকার সময়টাকে কাটিয়ে পৃথিবীসুস্থ হয়ে উঠবে। জীবনের ছন্দ তার হারিয়ে যাওয়া সুরকে আবার ফিরে পাবে..!

Comments

পাঠকের পছন্দ