সম্পর্ক মণ্ডল

খিদের রাজত্বে ভাতের গান গাইছি


আজ পেট ভরে খেয়েছি ভাত কিন্তু কাল?  কাল কি আবার খিদের জন্য ভাতের গান গাইবো? কাল কি আবার চল্লিশভাগ মানুষের পেটের ভেতর ঢুকে শুয়ে থাকবো চুপটি করে? তারপর একদিন খিদেকেও খেয়ে ফেলবো চুপিচুপি। ভরপেট খাবো খিদের খিদেকে৷ আমি তো খিদের সন্তান।আমার বাপ খিদের সন্তান। আমার মা খিদের সন্তান। আমিও কি তার ব্যতিক্রম হতে পারি? কাল চল্লিশভাগ থেকে ষাট ভাগের দলে ঢুকে যাবো, পরশু ষাট ভাগ থেকে আশি ভাগের দলে ঢুকে পড়বো নিমিষেই।  প্রথমে নিজেকে খাবো তারপর স্ত্রী সন্তানের পাতে ফ্যান ভাতে বিষ মিশিয়ে দেবো। তারা তো আমার খিদের ভাগে জন্ম নেয় নি তাহলে কেন তাদের খবরের কাগজের খবরে ফুলে ওঠা পেট হতে দেবো?  যে খবর আমাদের এক মুঠো ভাত দিতে পারে না কিন্তু ভাতহীনতার গল্প পৌঁছে দিতে পারে লকডাউনের বিরিয়ানি খাওয়া সেলিব্রেটির ঘরে। আমি কি আমার নাম পবন কুমার বলে ডাকবো? আমি দিল্লি থেকে  এক প্যাকেট বিস্কুট সম্বল করে হাঁটতে হাঁটতে পাটনা আসবো ফিরে? আমি কি আমার মোবাইল বিক্রির টাকায়  চাল ডাল কিনে এনে আমার সন্তানকে ভাত বেড়ে দেবো যত্ন করে? মাঝরাতে সকলে ঘুমিয়ে গেলে ফ্যানের সঙ্গে নিজের দেহকে ঝুলিয়ে দেবো যত্ন করে? অনেকদিন পর পেট ভরে খেতে পেয়ে আমার সন্তান কী ভাববে মাঝরাতে? দেখবে একটা খাদ্যোক্ষম পিতার নিথর দেহ ফ্যানের সঙ্গে মাঝরাতে কথা বলছে নীরবে।তারপর  সেই সন্তানই বা বাঁচবে কদ্দিন? খিদের টাকাতে স্বামী হারিয়ে সন্তানের মা বেশ্যা হবে। প্রিয় সন্তান একদিন মাঝরাতে হাপুস নয়নে কেঁদে উঠবে হু হু করে আর তার বাপের প্রতি খিস্তি দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়বে আবার। আহা সন্তান আমার, খিদের জগতের দান তোর বাপ না হয় মরে যাবে কিন্তু তুই মরিস না বাপ আমার। আমি তোর হাড় গিলগিলে শরীরে হাত বুলিয়ে দেবো। আমি পুকুর থেকে গুগলি, হেঞ্চা, শুশুনি শাক তুলে সেদ্ধ করে খাওয়াবো। লকডাউন কী জিনিস আমি জানি না বাপ। করোনা রোগ কী জিনিস আমি জানি না বাপ৷ আমি জানি অনাহার। অনাহারে ছটপট করে মরে যাওয়া। একটু ফ্যানের জন্য বড়োলোকের বাড়ির সামনে শুয়ে থাকা। আমি যদি জঙ্গলমহলের শবর পিতা হই তাহলে আমার লকডাউনে প্রসাদ হল কচু পাতা সেদ্ধ খাওয়া। আমি যদি কোচবিহারের নদীঘেরা জায়গায় জন্মায় তাহলে রেশন দোকানের চালের জন্য আমাকে হাপিত্যেস অপেক্ষা করতে হয় সারামাস। আমি যদি অসুস্থ সন্তানের পিতা হই তাহলে পুলিশের লাঠির ঘায়ে আমার মৃত্যু হয় আর আমার প্রিয় সন্তানের মুখে এক ফোঁটা ওষুধ পড়ে না কখনও।  আমিই সেই সন্তানের পিতা যে রেশন দোকানের দু কেজি চালের লাইনে দাঁড়িয়ে পুলিশের হাতে মার খেয়ে বাড়ি ফিরি খালি হাতে৷ আমি সেই সন্তানের পিতা যে সন্তানের মুখে ভাতের তুলে দিতে পুলিশ সেজে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াই, আবার জনতার পাথর ইট বৃষ্টিতে মাথা লুকিয়ে বাড়ি ফিরি চুপিচুপি। 

আমরা সবাই আজ খিদের সন্তান। খিদেই আমাদের উত্তরাধিকার। খিদের জন্য আমরা মরবো একদিন, আর কোনও আমাদের অভাবের পেটকে মারতে পারবে না কোনো রোগ,  কোনোদিন। 

Comments

পাঠকের পছন্দ