সৃজনী মণ্ডল

বন্দিযাপন



 প্রায় দেড়মাসব্যাপী এমন বন্দিজীবন কাটছে আমাদের। আমার একুশ বছরের জীবনে এই অভিজ্ঞতা সত্যি অভিনব। বিশ্বজুড়ে মানুষ আজ গৃহবন্দি। জানতে পারলাম প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়াল পরিস্থিতিতেও নাকি এমন অবস্থা কখনও হয় নি। তবে ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ভাইরাস নামে এরকম একটি আকস্মিক আক্রমণ গোটা বিশ্বে কয়েক মিলিয়ান মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক সরকার তখন কীভাবে এই উপমহাদেশে সেই পরিস্থিতি সামলেছিলেন তার নির্ভরযোগ্য কোনও প্রমাণ মেলেনি। তবু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী তিরিশের দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দা কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে পঞ্চাশের মন্বন্তরের(১৯৪৩) ভয়াল অর্থনৈতিক সংকটের দিনগুলির কথা আবার যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে এই বর্তমান পরিস্থিতি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুঃশাসনীয়’ কিংবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ যে ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়, আমরা কী আরেকবার সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চলেছি? অভূতপূর্ব লকডাউনের মধ্যে করোনা আশঙ্কায় ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সেই ইতিহাসের কথা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে। এখন মানুষ দিন কাটায় ভয়কে সঙ্গী করে। মৃত্যভয়; জীবনকে হারিয়ে ফেলার ভয়।
সেই ১৫ মার্চ থেকে বন্দি হয়ে আছি ঘরে। চারিদিকের বহুতলের উচ্চতা পেরিয়ে আমার বারান্দার জানালা দিয়ে যতটুকু আকাশ দেখা যায় মন যেন সবটা লুফে নিতে চায়। আগে এমন করে কখনও তো আকাশ দেখতে চাইনি। খোলা মাঠের নিচে বসেও না। তাইতো কথায় বলে, দুর্লভের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। সহজে-প্রাপ্তির মূল্য নেই।
 আমার শহর বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে চেনা-অচেনা মুখগুলোও। এক অনন্ত নির্জনতা যেন নারীবেশে এসে তার আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে গোটা শহরের গায়ে। বাড়ির সামনের গাছটায় এখন নানান রঙের পাখি এসে বসে। কত বিচিত্র তাদের গলার স্বর। সুরের দোলা দিয়ে যায় মনে। কারও সুরে ইমন, কারও সুরে ভৈরবী, আবার কারো সুরে বর্ষার মিয়াঁ-মল্লারের আবেশ। ছন্দ যেন সই তার। এরই মাঝে চোখে পড়ল পাশের বাড়ির ঝুলবারান্দাটার এক কোণে এক মা কাক বাসার মধ্যে বসে থাকা ছোট্ট জীবনগুলোকে খাওয়াচ্ছে। তার স্নেহভরা চাহনি হয়তো দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে আগে কখনও টেরই পেতাম না। 
একথা ঠিক প্রথম প্রথম এই বদ্ধ জীবন দুঃসহ হয়ে উঠছিল। প্রিয় বন্ধু প্রিয় মুখ এসব তো একরকমের অভ্যেস। সহজে কী ছাড়া যায়? দৈনন্দিন জীবনের গতি হারিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। অবকাশেরও তো নির্দিষ্ট সীমা থাকে। কিন্তু অজান্তেই এই নির্জনতাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ব্যস্ততা নেই কোনো। বারান্দার স্ল্যাবটায় বসে ফাঁকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মন কখন চলে যায় কোনো এক নদীর ধারে। সেখানে অচেনা ফুলের গায়ে মৌমাছির গুঞ্জন। আনমনে গেয়ে উঠি ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে/আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে’। কিন্তু ঠিক সেইসময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত চেতন ফিরে আসে। কত বিচ্ছেদ, কত বেদনা, কত মৃত্যুর স্মৃতি রোমন্থিত হয়। হতাশা গ্রাস করে। একটা গান শুনেছিলাম ‘একা বেঁচে থাকতে শেখো প্রিয়’। হতাশা এলেও এই একাকী জীবন আমাকে নিজেকে চিনতে শিখিয়েছে। এমন মৃত্যু আশঙ্কার মাঝেও মনে হয় আর যদি একটা দিনও বাঁচি, নিজেকে ভালোবেসে বাঁচবো। শত দুঃখেও ফিরে দাঁড়াবো। কবি রুদ্রের কথায়, “বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন, এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত”।              
তবে এই যাপন যদি দীর্ঘমেয়াদী হয়, সেক্ষেত্রে কর্ম-জীবনের স্বাভাবিক ছন্দপতন ঘটবে। এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়েরও সম্মুখীন হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তবু এইটুকুই আশা রাখি এই দুঃসময়ের বাতাবরণ একদিন সরে যাবে। কোনো এক নতুন ভোরের অপেক্ষায় আমরা দিন গুনি। সুস্থ হোক আমাদের আগামী জীবন, যাপন। সুস্থ হয়ে ওঠো পৃথিবী।

Comments

পাঠকের পছন্দ