পুন্যতোয়া

দিনবদল



ক্ষরস্রোতার মতো একটানা ঘড়ির কাঁটার সাথে বয়ে যাওয়া ব্যস্ত শহরটা নিশ্চুপ, ক্লান্ত, ঘুমন্ত।  লক্-ডাউনের আজ ২৮ তম দিন, ৬৭২ ঘন্টা লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে গিজগিজে ভিড় আর মেছো গন্ধ মেশানো, " আমি অন্ধ মানুষ দাদাভাই দুটো পয়সা দেবেন? " শোনা যায়নি; সিমেন্ট-বালি কাদামাটির আস্তরণে কোদালের দুমদাম, হাতুড়ির ঠকাঠক তান ওঠেনি; আপিস টাইমের ক্লান্ত জ্যামে  কান ফাটানো বাস-লড়ির  হর্ন এর সাথে স্বচ্ছ বাতাসে মেশেনি পেট্রোলের বিষ-বায়ু; বিপুল রক্তমাখা প্রতিবাদ ঝড়ে ওড়েনি বিজয়-পতাকা আর 'ছাত্র-  আন্দোলন জিন্দাবাদ' কলরব, ধর্মান্ধের 'কাগজ দিখাও' এর বিরূদ্ধে আজাদির ডাক। ইস্কুল-বাড়ির ঢংঢং ঘন্টা বাজেনি, ফুচকাওয়ালার চারদিক ঘিরে নেই ছয় বান্ধবীর অবিরাম কলতান, পাড়ার চায়ের দোকানে নেই পলিটিক্যাল কু্ৎসা রটনা। কান পাতলে শুধু শোনা যায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা গণনা, সতর্কবার্তা, রঙীন রাজনীতির মিথ্যে প্রতিশ্রুতি মাখানো দ্বন্দ,  অত্যাচার, কলহ; টুংটাং কাসর-ঘন্টা, বোমা-বাজি আর দুস্হের ভুখা পেটের হাহাকার। ইতিমধ্যে, অস্পৃশ্যতা ভুলে বন্ধুত্ব হয়েছে রেল-বস্তির সোফিয়া আর রাধার। সরকারি বাবুদের দেওয়া স্বল্প  চালডাল ভাগ-বাটোয়ারা করে চালিয়ে নিচ্ছে দুই পরিবার। ফুটপাতের ধারে রহিম চাচা আর বিশু পাগলা খালি পেটে চারদিন ছটফট করেছে; কোন একটি ক্লাবের social worker রা  নাকি  ঈশ্বরের মতো এসে  তাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে। তাদের দৌলতে দুথালা ভাত, চাচা, বিশু আর হাড় জিরজিরে চারটে নেড়ি মিলেমিশে খায়। ঠিকে ঝি না আসায় বড়োলোক গিন্নির মাথায় হাত, দুবেলা কত্তাকে লিস্টি দিয়ে বাজারে পাঠায়, মেয়ে Facebook  এ রেসিপি দেখে নতুন নতুন experimental  রান্নার জন্য নানারকম ফর্মাইশ করতে থাকে। মাস্ক-বাদী মধ্যবিত্তের বুদ্ধি ও lock-down এ। প্রতিদিন দোকান বাজার উপচে পড়ছে ভিড়ে। হবে নাই বা কেন?  রবিবার কচি পাঠার ঝোল, মিষ্টি দই, রসগোল্লা আর ম্যাটিনি- শ্যোর বিলাসিতা একটা সামান্য ভাইরাস পন্ড করবে কে ভেবেছিল?  ইদানীং প্রেমিকার সাথে মনের দুরত্বটা বাড়ছে আঁচ্ করতে পেরেই হয়তো ১৫ টা মিস্ড কল দেখে বিরক্ত হয় প্রেমিক। না, work from home  এর চাপটা প্রেমিকারই তার নেই। বেকারত্বে জিবনের কাছে পরাজিত যুবক। যেটুকু আশা ছিল তাও আর রইল না। Engineering পাশ ছেলে ভেবেছিল কিছু  না হলে মঞ্চটাই বাঁচিয়ে রাখবে। দু চোখের পাতা এক হলে সামনে দেখে অন্ধকার ফাঁকা চেয়ারগুলো থেকে করতালির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।  ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে গামছা দিয়ে ঘাম মোছে, সেটা গলায় জড়িয়ে ওপরে ঘুরন্ত পাখাটার দিকে একবার চায়, তারপর দেওয়ালে বাবার ছবিটার দিকে একবার তাকিয়ে মাকে জাপটে ধরে আবার চোখ বোজে। খবরে ডাক্তার-নার্সদের মৃত্যু সংবাদে বুক কাঁপে মায়ের। একটিমাত্র মেয়ে,নার্সিং পড়িয়েছিল তাকে,বাবার বুক গর্বে ভরে ওঠে তার কর্ত্যবে অবিচল থাকা,দূর্গার ওপর । 'বর্ডারে আমাদের সৈনিক লড়ছে!' না, 'হাসপাতালে আমাদের ডাক্তাররা লড়ছে।'আর লড়ছে কোটি কোটি প্রাণ একটা অকোশিয় ছোট্ট জীবের  সাথে ।আশা বুক বেঁধে সুস্হ পৃথিবী আর দু মুঠো চালের স্বপ্ন লাখ -লাখ মানুষের চোখে।দেশ ডিজিটাল হল,Internet Quarantine জীবনকে দীশা দেখালো, online class দেশকে বানালো বিদেশ ,পৃথিবীর statistics বদলালো,রাজনৈতিক অশ্লীলতাকে চ্যালেঞ্জ করলো করোনার নৈতিক বিষ।বদল এলো-   বদল চেয়েছিলে না? জনজীবনের এ বদল গ্রাহ্য হচ্ছেনা বুঝি? চেয়ো দেখো আকাশের রঙে কিন্তু বদল আসেনি , মেঘের ডাক একই রকম,নদীর কলকল ধ্বনি,গাছের পাতার রং,পাখির ডাক,হাওয়ার শনশন,মাটির সোঁদা গন্ধ,পাহাড়-জঙ্গলের বন্য সুখ,আর লেখকের কলম বদলায়নি একই আছে|

Comments

পাঠকের পছন্দ