নন্দলাল মজুমদার

আমার গ্রামের প্রাইভেসি 


(বন্ধুরা এই কদিনে প্রচুর মেসেজ করেছে, চ্যাট করেছে, কল কিম্বা ভিডিও কলও। আমি তোদের/ তোমাদের কিছু পার্সোনাল কথা তুলে দিচ্ছি। আগে থেকেই সরি বলে রাখছি। জানি তোরা/ তোমরা আমাকে মার্জনা করে দিবি/ দেবে। ) 

 
আমার প্রথম বন্ধু আমার এক বৌদি। আমি তার নাম রেখেছি পুটুস। সে আমার নতুন গানের প্রথম শ্রোতা। কদিন ধরেই তাকে খেপাচ্ছিলাম-- এবার তোমার একটা গণেশ হবে-- নাদুস নুদুস ভুড়িওলা। বৌদি বলে, তোমার শুধু পাকা পাকা কথা। ওর এখন অফিস বন্ধ। ওয়ার্ক ফ্রম হোমও হচ্ছে না। এই কদিনে পুটুস খুব রান্নাবান্না করছে। রান্নার কথা আসতেই পুটুসের হাতের খিচুড়িটা আমার খুব মনে পড়ে। আমাকে বলল-- এখন সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করছে। মানে ফ্যামিলির সবাইকে। আর সময় পেলে দু-এক লাইন ডায়েরিতে লিখছে, এটা অবশ্য আমার রিকুয়েস্টে।  আগের দিন পুটুস ডায়েরির একটা পাতার ছবি তুলে আমাকে পাঠাল। যাতে আমি বিশ্বাস করি যে হ্যাঁ-- লিখছে। 

আজ সারাদিন অনেক রান্না করলাম। তোমার দাদা তো প্রচুর জিনিস আগে থেকেই কিনে রেখে দিয়েছে। তুমি তো জানো আমাদের অনেকগুলো মুরগি আছে। একটা কাটা হয়েছিল। ভালো করে কষে বানালাম। তোমার দাদা তো আবার একটু ঝাল ভালোবাসে-- ঠিক তোমার মতো--। মা-বাবাকে আজকাল সুপ বানিয়ে দিই। মানুর দু-জন টিচার অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। সারাদিন ভালোই ব্যস্ত থাকি। আর সন্ধে হলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। টিভি-তে নতুন কোনও প্রোগ্রাম নেই। ইউটিউবে টুক টাক কিছু দেখি। আর তোমার দাদা নিউজ চ্যানেল দেখে। আজকাল খুব কাছে আসতে চায়। আমরা অনেকদিন বাদে অনেকটা সময় পেয়েছি। ভেবেছিলাম আবার অনেক কথা বলব। সেটাও যে খুব হয়ে উঠছে এমন নয়। ও হ্যাঁ-- অ্যামাজন প্রাইমে ফ্যামিলি ম্যান দেখলাম। তুমি বলেছিলে। মনোজ বাজপেয়িকে খুব বুড়ো বুড়ো দেখাচ্ছে--। কাল রাতে আমরা অনেকবার করেছি। আজ সকালেও আবদার করছিল। কিন্তু আমি একটু উল্টোপাল্টা বলে ফেললাম। রেগে গেলাম কেন আমি নিজেও জানি না। তুমি বলবে মুড সুইং। সবই হচ্ছে-- সকাল থেকে বাড়ির কাজ, তোমার দাদার ভালোবাসা, রাত হলেই আমরা পাগলের মতো আদর করছি। কিন্তু কী যেন একটা নেই। কী যেন একটা মিসিং। আজ খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে। রাতে খাওয়া দাওয়া করে ছাদে গেছিলাম। বলছিল নাকি চাঁদটা পিঙ্ক দেখাবে। কই আমি তো বুঝতে পারলাম না। তুমি দেখলে? তুমি তো রাতে ছাদে বসে সিগারেট খাও। এবার একটু কমাও। তোমার দাদারও সিগারেটের স্টক ফুরিয়ে এসেছে। এবার তোমরা আর পাবে না। ভালো হবে। তোমাকে সামনে থেকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। জানো তো এখানে একটা মজার ঘটনা…

বাকিটা পরের পাতায় আছে। আর ছবিতে এতটা। বৌদির হাতের লেখাটা চমৎকার। প্রতিটা অক্ষরে বেশ যত্ন। কাটাকুটিও নেই। রাত তখন দুটো। আমি ছাদে উঠে চাঁদটাকে দেখলাম। মনে হচ্ছিল ধোঁয়াশায় ঢেকে গেছে। তখন পুটুসের একটা টেক্সট পেলাম। 
আছো? 
হ্যাঁ-- তোমার পাশে। 
ঘুম আসছে না। আমি একটু উঠে এলাম। 
বলো। 
সবই তো আছে। আমার হাসব্যান্ড আমার ফ্যামিলি আমার মেয়ে। তবু মনে হচ্ছে কী যেন একটা নেই! কী যেন একটা মিসিং! 




 
তাপস। আমাদের গ্রামের ছেলে। ও ছিল এই গ্রামের মাসলম্যান। এখন লোকাল থানায় আছে। দিনের বেলা তো ওকে পাওয়া যায় না। এখন রাতে পাওয়াও টাফ। একদিন পেলাম। 

তোদের তো এখন খুব প্রেসার!
প্রেসার ছাড়-- এতদিনে পুলিশের চাকরিটাকে খুব এনজয় করছি!
কিং মনে হচ্ছে তো? গ্রামের রাস্তায় সকাল সন্ধে পুলিশ ঘুরছে। এ সিন দেখিনি ভাই। তোরা এসে শুনলাম ধাপুডি গ্রামে এসে খুব কেলিয়েছিস! ভয়ে কেউ রেশন তুলতে যেতে পারছে না। মাঠে হাগুমুতু সব বন্ধ। নীচুপাড়ার বৌগুলো একসঙ্গে পুকুরে যেত, তারাও ভয় পাচ্ছে! 
না--না--। পাবলিক ক্যালানোর কাজ আমার নয়। আমাকে অন্য ডিউটি দিয়েছে!
অন্য ডিউটি মানে?  
তুই তো জানিস একটু টুকটাক গানের ব্যাপারটা--। ওটাই আর-কি! ডিপার্টেমেন্টে অফিসাররাও জানে তো--! তাই এখন আমি গাড়িতে করে যাচ্ছি আর গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেড়াচ্ছি। ওটাই কাজ। আমাদের পুলিশের দল নয়-- গানের দল--। ভাই, জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা! জীবনে গানটাই তো গাইতে চেয়েছিলাম! কোথা থেকে যে কী হয়ে যায়! স্যার বলেছে মেডেলের ব্যবস্থা করব। 
সাবধানে থাকিস--এত ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। 
শোন না-- আমতোড়া পেরিয়ে ডুমুরসোঁতা গ্রামটা জানিস? 
হ্যাঁ। 
ডুমুরসোঁতার শাঁখারিপাড়াটা আছে না! আরে যেখানে তেলেভাজার দোকানগুলো আছে! ওখানে শাঁখারিদের একটা মেয়েকে আমার ভালো লেগেছে।
ফাটিয়ে। তারপর? 
রোজ এভনিং টাইম-এর একটু আগে ওখানে গিয়ে গান শোনাই। ওই মেয়েটা রোজ দাওয়ায় এসে দাঁড়ায়।  চোখে চোখে কিছু কথা হয়। 
করোনার দিনগুলিতে প্রেম। 
ভাই এবার বিয়েটা হয়ে যাবে বল? 
করোনা শেষ হলে অনেক বিয়েবাড়ি হবে। 
আমারটাও লাইনে আছে। 
গান গাইতে একবার আমাদের গ্রামেও আসিস ভাই। 
যাব। 




ডোমপাড়ার চাঁদু। আমাদের গ্রামের নাম্বার ওয়ান অ্যালকোহলিক। আমার বন্ধু। সবাই ওকে চাঁদু মাতাল নামে চেনে। অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চুল উস্কোখুস্কো। বহুকাল তেল পড়েনি মাথায়। একটা নোংরা লুঙি আর ছেঁড়া স্যান্ডোগেঞ্জি পরে থাকে। মদ খেয়ে দিনে দুপুরেও ওকে রাস্তার ধারে উল্টে থাকতে দেখা যায়। কখনও কখনও মজদুরি করে, যা পায় তাই দিয়ে শুধু মদ খায়। চুল্লু, হাঁড়িয়া এসব। ভাগ্য ভালো থাকলে বাংলাও জোটে। লোকটা এত মদ খেয়ে এতদিন বেঁচে আছে কী করে-- সেটাই রহস্য! দিন দিন নাকি আরও জোয়ান হয়ে উঠছে। 

রাতে ছাদে বসে আছি। এগারোটা নাগাদ। চারদিক খাঁ খাঁ করছে। রাতচরা পাখির ডাক, আর দূরে থেমে থেমে কুকুরের ডাক। ছাদ থেকে একটা পুকুর দেখা যায়। পাঁড়েদের পুকুর। তার ওপাশে গাছপালা, আর এক পাশে একটা ছোট্ট মাটির ঘর। ওদিকটা বাউরি পাড়া। চাঁদের আলোয় মনে হতে পারে শুটিং-এর সেট। সেই মাটির ঘরে চোলাই মদ বিক্রি হয়। ওখান থেকে কেউ চিল্লিয়ে কিছু বলছিল। রাতের নিস্তব্ধতায় হালকা হালকা শুনতে পাচ্ছিলাম--। চাঁদুর গলা--  

জানি সালা তুর কাছে চুল্লু আছে। বার কর সালা। তুই লুকাই লুকাই বাংলা বেচছিস। ডবল দাম লিছিস--। পুলিশ জানতে পাইরলে তুকে বাঁশ দিবেক। অল্প দে রে-- রোজ না খেয়ে লারছি থাকতে-- তুই দিবি কিনা বল বোকাচোদা? 
চাঁদু অনেকক্ষণ চিৎকার করে থেমে গেল। বুঝতে পারলাম কোনও লাভ হল না। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আবার একবার চেল্লাতে শুরু করল, সালা কী ভেবিছে--পয়সা দুব নাই! ডবল দাম লিবি তো ক্যানে দুব? তুরা আমার ছুটুখোকা-- আমি কি আজকের লোক বটি? তুর মায়ের ঠিক ছিল নাই-- কোন ঠাকুরের ঘরে ঢুকিছিল, সব জানি--! আমাকে মদ দিলি নাই তো তুই সালা করোনাতে মরবি।  আমি অভিশাপ দিছি তুই করোনাতে মরবি।       




দাদু আমার বন্ধু। ছাদের ঘরে থাকে। আজ সকালে দাদু যখন বাথরুমে গেছিল, আমি তখন নিজে চা বানিয়ে দাদুকে দিতে গেছিলাম। বালিশের পাশে একটা ছোট ডায়েরি ছিল। দাদু তাতে ওষুধ পত্রের হিসেব,  তিথি টিথি এসব লিখে রাখে।  কখনও জমিতে কত বীজ, কত সার পড়ল তার হিসেব থাকে। আমি ঘর ফাঁকা দেখে চশমাটা সরিয়ে ডায়েরিটা তুলে নিলাম-- 

ওঁ 
সকল ব্যাপারটাই চীনদেশের কারসাজি। শুনলুম নাকি অনেক লোক মারা যাচ্ছে। সরকার কী আর সব হিসেব দিবে। আমার শিশুকালে একবার দুর্ভিক্ষ এসেছিল। এই গাঁয়ে নিজচক্ষে লোক মরে পড়ে থাকতে দেখেছিলুম। সরকার তখনও দেখে নাই, এখন দেখবে এমন আশা কী করে করি? শঙ্কর আর মতিলালকে দিয়ে ক্ষেতে কুমড়া আর শশা লাগাব ভেবেছিলুম। ঘরে বসে বসে দিন গুনছি।  গাঁয়ের বুনিয়াদি বিদ্যালয়টিকে সরকারে নিয়েছে, শুনলুম রোগীদের খাট পাতা হবে। তা উত্তম।  বিদ্যালয়টি এমনিতে ভোজনালয়ে পরিণত হয়েছিল। এতদিনে কোনো কম্মে এল। সুধা আর আমার প্রথম সন্তান হয়েছিল এই গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখন ছাগল চরে বেড়ায়। বহুকাল হল ডাক্তারবাবু আসা বন্ধ, ওষুধ পাতি কিছুই ছিল নাই। অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এত বেড়েছিল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি ইঁটও অবশিষ্ট রাখে নাই। সেকালে দশখানা খাট ছিল। সকলরকম ওষুধ ইঞ্জেকশন ছিল। বেগুনবাড়ির জঙ্গলের ভিতরে যে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল, আমার নাতিসাহেবদের আর জানা হল নাই! নাতিসাহেবরা বড়ই অভাগা। বাবার মুখে শুনেছি বেগুনবাড়ির জঙ্গলে নাকি নেতাজীর গাড়ির টায়ার পাংচার হয়েছিল। শিশুকালে ঐ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমি নিজে পিসিমাকে নিয়ে কতবার হাজা কাটাতে যেতুম। পিসিমা হাজা-র সমস্যাতে ভুগতেন। খালভরাগুলো বেগুনবাড়ির জঙ্গলের গাছগুলোও কেটে ফেলল । সুধার যখন প্রসবযন্ত্রণা ওঠে, ঐ জঙ্গলে আমি সারারাত্তির জেগে জেগে কাটিয়েছিলুম। পরদিন শুনলুম সুধা আমার বড়পুত্রকে পৃথিবীতে এনেছে। সুধা, ঘরে বসে বসে তোমার কথা খুব মনে পড়ে। কত কিছুই তোমাকে আর বলা হল নাই। তুমি আমার মনি ছিলে। কত অল্প বয়সে তোমাকে আমি বিবাহ করেছিলুম। আমি আমার মনিটিকে হারাইয়াছি। তোমাকে আরেকটিবার চুমা দিতে ইচ্ছা করে। আমি তোমাকে সারাজীবন কষ্ট ছাড়া কিছুই দিতে পারি নাই। তুমি এখন থাকলে মনে জোর পেতুম।  তুমি থাকলে জানতুম কোনও অসুখেই আমার কিছু হবে না। আমি আবার সেরে উঠব। মনে পড়ে আমার কিডনিতে পাথর হয়েছিল। অস্ত্রোপচার হল। তুমি মাথাসিথেনে বসে থাকতে। তুমি কপালে হাত বুলিয়ে দিলে আমি সব যন্ত্রণা ভুলে যেতুম।  এতগুলো সন্তান মানুষ করেছ, আমিও তোমার সন্তানের মতোই ছিলুম। আমার খুব ভয় করে জানো সুধা। মৃত্যুভয় নয়-- যদি আমার এই রোগটা হয়-- তাহলে আমার দেহটাকে ওরা  কোথায় ফেলে দেবে কে জানে! সৎকারকার্যাদিও আর হবে নাই। পৃথিবী ছেড়ে একদিন তো চলে যাব কিন্তু এইভাবে এই হেন নির্মমতায়, স্বপনেও ভাবি নাই। আমার বাবা বলতেন, মড়কের মরা আর শকুনের চরা। ভয় করে খুব। ঈশ্বর সহায়। 

দাদুকে সেদিন দুপুরে খালি গলায় গাইতে শুনলাম। আমি আমার কানের থেকে হেডফোনটা খুলে কিছুক্ষণ চুপচাপ। ‘এমন মানব জনম আর পাবে না... বারে বারে আর আসা হবে না’। 




রাহির ফার্স্ট ইয়ার কলেজ। ছোট থেকেই বড্ড পাকা।  ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা কী করে হল-- সে বিশদে আর যাচ্ছি না। রাহির চোখগুলো হরিণের মতো। মাঝে মাঝেই ওর প্রোফাইল পিকটা পিং করে আমার মোবাইল-স্ক্রিনে ভেসে ওঠে।  

আজ টিক্‌ টক্‌ করব। 
রোজই তো করছিস!  
কাজ নেই তো কী করব? এক্সাম ক্যানসেল। কবে হবে জানি না। পড়তে ভাল্লাগছে না। শুনলাম রাধানগর গ্রামে করোনা ধরা পড়েছে। হোয়াটস্‌ অ্যাপে এল। সত্যি? 
ওটা ফেক নিউজ। 
কী জানি! 

আমার স্টেটাসটা দেখেছ? 
না। 
তুমি যে দেখবে না, আমি জানতাম। 
দেখে নেব। আমার জন্য ছিল?
থাক। 

তুমি অমন বুড়ো বুড়ো পিক্‌ দিয়েছ কেন? 
করোনার জন্য আমাদের বয়স বেড়ে গেছে। 
সবসময় করোনা করোনা ভাল্লাগছে না। 
করো করো!
ইশ! কি বাজে! তুমি তো ছাদে দাঁড়ালেও আমি দেখতে পাব না! গাছে ঢেকে যাবে।  আমি যদি পাখি হতাম। 
তাহলে তেঁতুল গাছটায় এসে বসতিস। 
এতক্ষণ গ্রুপে হেবি বাওয়াল হচ্ছিল। 
তুই যে গ্রুপে আছিস, সেই গ্রুপে তো বাওয়াল হবেই। 
মোটেও না। একটা গান শোনাও না--। ভিডিও কল করি? 

ন্যাপকিন শেষ। আজ স্টার্ট হয়েছে। 
যাহ! তাহলে? মায়ের থেকে নিয়ে নে। 
মায়েরও নেই। তুমি জানো শান্তিকাকুর মুদিখানার দোকানে রাখত। লকডাউনের আগে যা স্টক ছিল। তারপর আর আনতে পারেনি। ওষুধের দোকানেও নাকি এখন দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আর টাউনের বাজারে কেউ গেলে তো পুলিশে আটকাচ্ছে। 
তাহলে তো প্রবলেম হয়ে গেল। 
সলভ হয়ে গেছে। পাশের বাড়ির মিনুকাকিমার থেকে নিয়েছি। 

আমি আজ সেজেগুজে বসেছিলাম জানো। ছাদে গেলাম। 
তাই? পিক পাঠা। 
কোথাও বেরোনোর আগে যেমন সাজি। নতুন একটা জামা পরে বসেছিলাম। দুর্গাপুজোয় পরিনি। 
তারপর? 
মনে মনে খুব ছটফট করছিলাম। সেলাই-এর একটা কাজ করলাম। বোনের পুতুলগুলো নিয়ে পুতুল খেললাম। পুতুলদের কোনও ঝামেলা নেই। সবসময় আদরে আদরে থাকে। 
হুম।
আজ বাবা মা-কে মেরেছে। আমার খুব কষ্ট হয়েছে। বাবারও দোষ নেই। চৈত্র সেল-এর জন্য এত মাল তুলল! সব ঘরে গাদ হয়ে পড়ে আছে। ওগুলো দেখলে মাথা খারাপ তো হবেই! 
এখন কী করছিস? 
পুতুলদের ঘুম পাড়ালাম। ওরা এখন শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। 
নতুন জামার পিকটা পাঠা। 
তোলা হয়নি। 




আমাদের গ্রামের একটা হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ আছে। নবরত্ন বিরাজ করেন সেখানে। কেউ ভক্ত  কেউ অসুর কেউ গেমার কেউ ল্যাদখোর। সবরকম পাবলিক তাতে আছে। গ্রুপে গ্রুপে যা হয়।  

তোরা ভাই ফেক নিউজটা ছড়ানো বন্ধ কর। 
কে ফেক নিউজ ছড়াচ্ছে? 
তোরা ছড়াচ্ছিস। আমাদের পাশের গ্রামে মুসলমান পাড়ায় করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে এসব কী ভাই? তোদেরকে দেয় কে বলতো?  
তুই জানিস ওখানে নিজামউদ্দিনের গান্ডুগুলো ঢুকে আছে। 
সব মুসলমান পাড়াতেই নিজামউদ্দিন টানছিস কেন? 
দাঁড়া আমি তোকে পেপার কাটিং পাঠাচ্ছি। 
ওগুলো সব ফেক। ফোটোশপ করে বানানো। 
কুল ম্যান! আমরা অন্য একটা টপিকে ঢুকি। 
টপিকে ঢোকার তো কিছু নেই। এই রাজ্যে কী হচ্ছে সেটা সবাই জানে! সব জায়গাতে রেশন যাচ্ছে না। 
তোরা তো সবাইকে প্যানিক দিচ্ছিস-- আর হিন্দু মুসলিম করছিস! রহমতডাঙার বুড়োটা বয়স হয়েছে মারা গেছে। তোরা ওকে কোভিডে মেরে কী প্রমাণ করতে চাইছিস? 
আর প্রমাণ করার তো কিছু নেই। আর-পার হবে এবার। ওরা মসজিদে এখনও জমায়েত করছে। পুলিশ কিছু না করলে এবার আমরা ব্যবস্থা নেব। 
রেগে যাচ্ছিস কেন? ও তো কোনও দোষ করেনি! 
ওর দোষ নেই-- ওদের পার্টিটার দোষ! কী করেছে-- ভেবেছিল একবারও  দেশে এত লেবারার আছে--কী খাবে কোথায় যাবে তারা? 
আজ ধোনপুর গ্রামের ঘটনাটা শুনলি। ওরা বাড়া দুদিক থেকে রাস্তা আটকে বাড়া পোস্টার মেরে দিয়েছে বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ।  
খড়খড়ি গ্রামেও তো তাই করেছে। 
সব গ্রামগুলো এটা করতে শুরু করলে চাপ আছে ভাই। তালডি-তে একটা মুদিখানার দোকানও নেই। ওষুধ কিনতে এখান থেকেও টাউনে যেতে হয়। দুধ সবজি এসব আসবে কোথা থেকে! এমার্জেন্সিতে লোক যাবে কী করে? 
ওরা রাস্তায় বসে বসে আড্ডা দেয়। পুলিশ যাতে না ঢুকতে পারে তার ব্যবস্থা।  
বেশ করেছে। আমাদের গ্রামেও এরকম করে দেওয়া উচিত। সালা ইঁটভাটাতে মহামেডানগুলো কাজ করে। গ্রামের পুকুরে জল নিতে আসে। 
হ্যাঁ ওটাকে বন্ধ কর, ওদেরকে জলতেষ্টাতে মরতে দে! আর কয়লাচুরিটাকে চালু রাখ। 
এখনও কী করে কয়লা চলছে বুঝতে পারছি না। শয়ে শয়ে বাইরের লোক ঢুকছে।  
অন্ধা কানুন। 
আমি একটা বানিয়েছি--আমাদের গ্রামের কার্তিকের সঙ্গে রানু মণ্ডলের বিয়ে হবে।  
আমি বরযাত্রী যাব @রকিং চিন্টু 
সালা রাজেশ নীচে মারছে আর এদের বেশি পাকামো। 
সবগুলোকে কিক করে দাও। 
নীচে অ্যাটাক করিস না এখন। 
ওয়ার নিয়ে এখানে কেউ কিছু বলবে না। 
ওয়ার-ই তো চলছে।  
কেন বলবে না। 
এরা আবাল। কিছুই বোঝে না। 
ম্যাড ম্যাক্সকে কিক না করলে টু স্টার করত ফাইভ কে। 
তুমি টু স্টার করলেই জিতে যেতাম @কৌশিকদা 
সালা আমার পয়জন টা গেলো! 
ডেভিল থাক। 
লুন আর এস এস দাও কেউ।  




আমাদের গ্রামটাকে কোলে রেখেছে একটা পাহাড়। সে আমার ছোটবেলার বন্ধু। কেউ জানে না যে আসলে ওটা পাহাড় নয়। একটা পাখি। খুব ছোট, এইটুকু, পুচকে। আর পাহাড়ের যে বিশাল আকারটা আমরা দেখি, সেটা তার ডানা। ধুসর, প্রকান্ড। সারাদিন ওই ডানাদুটো ছড়িয়ে পাখিটা বসে থাকে। বছরের পর বছর। আমি গ্রামে থাকলে রাতে সে ডানা গুটিয়ে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়তে উড়তে আমার জানলায় এসে বসে। আমি ছোটপাখিকে একটা ছোট বাটিতে জল দিলাম-- 

আমার ডানায় খুব ব্যথা করছে। 
কেন? 
বয়স হচ্ছে তো। নতুন করে আর পালক গজাচ্ছে না। দিনের পর দিন লোকে কত পালক উপড়েছে বলো তো? 
আমার কাছে লাল ওষুধ আছে। একটু লাগাবে। 
ওটা তো মানুষের ওষুধ। পাখিদের নয়। 
গ্লোবালাইজেশনের যুগে সব এক। 
এমন গ্লোবালাইজেশন আমরা চাইনি! তুমি তো জানো আমি কেন তোমাদের গ্রামের পাশে থাকতাম? 
তোমার একটা বড় দায়িত্ব ছিল। সূর্যটাকে ওঠাতে হবে আবার নামাতে হবে।  
আর যদি আমার ডানাগুলো ভেঙে পড়ে। তখন কী হবে? 
এমন কথা বোলো না ছোটপাখি। তুমি তো আগে এমন বলতে না! আমার ভাল্লাগছে না। তোমাকে আমি কোনওদিন কাঁদতে দেখিনি।  
আচ্ছা। কাঁদব না। 
তাহলে একটা গল্প শোনাও--
আমার ডানার রংটা কী করে ধূসর হল জানো? 
কী করে?
আগে আমার ডানাটা রঙিন ছিল। সবুজ লাল নীল বেগুনি কমলা কত রকমের সব রং।  আমি যখন ডানা ছড়িয়ে বসে থাকতাম মনে হত যেন একটা রাজপ্রাসাদের গায়ে তুলি দিয়ে কেউ রং করেছে। 
তাহলে ধূসর হল কী করে? 
সেটাই তো বলছি। সে অনেক কাল আগের কথা। এক রাজা একবার আমার অঞ্চলে শিকারে এসেছিল। মন্ত্রী সেপাই সান্ত্রী ভাঁড় সবাই ছিল। রাজা শুধু খাওয়া দাওয়া করছে আর জঙ্গলে শিকার করছে। করতে করতে পুকুরে স্নান করতে এসে হুট করে রাজা একটা নুপুর কুড়িয়ে পায়। নুপুরটা ছিল হাতে বানানো। ফুল ফলের বীজ পাথর এসব দিয়ে। সেটা এতই মনোমুগ্ধকর ছিল, রাজাও তাতে মুগ্ধ হয়ে গেল। আর রাজা বলল এমন নুপুর যে পায়ে পরা হয়-- আমি সেই পা-টাকে কল্পনা করতে পারছি--সেই পরমা সুন্দরী নারীকে আমার চাই। আমি তাকে বিয়ে করে রানি করব আর তাকে অর্ধেক রাজত্ব দেব। খোঁজ শুরু হল। খোঁজ করতে করতে তারা সামনের গ্রাম থেকে একজনকে ধরে নিয়ে এল। যার অন্য পায়ে হুবহু এক রকম একটা নুপুর আছে। রাজা তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আবারও মুগ্ধ। বলল, আ হা-- এ তো স্বর্গের অপ্সরার পা দেখছি। মন্ত্রী তুমি ওর মুখের কাপড়টা সরাও--আমি একটু মুখটা দেখে হৃদয় জুড়াব। মন্ত্রী মুখের কাপড়টা  সরিয়ে দেয়। রাজার মাথার ওপর যেন বাজ পড়ে। নারী নয়, একজন কিন্নর। মন্ত্রী বলে, মাফ করবেন রাজামশাই। এমন নুপুর এ অঞ্চলে আর কেউ পরে না। রাজা বলল, না। আমি একে বিয়ে করতে পারব না। আর অর্ধেক রাজত্বও দিতে পারব না। রাজা কথার খেলাপ করছে দেখে মন্ত্রী সেপাই সান্ত্রী ভাঁড় সবাই একযোগে বলল, এ আবার কেমন রাজা? কথা দিয়ে কথা রাখছে না সে আবার রাজা কীসের? আমরা এমন রাজা মানি না। তারা সবাই রাজাকে জঙ্গলে ত্যাগ করে চলে গেল। মন্ত্রী গিয়ে রাজত্ব চালাতে শুরু করল। আর রাজা বেচারা জঙ্গলে পড়ে রয়ে গেল। দিনের পর দিন কষ্ট পেতে পেতে একদিন খুব জ্বর এল। সেই কিন্নর স্নান করতে এসে রাজাকে পড়ে থাকতে দেখে। সে তখন সেবা শুশ্রুষা করে গাছ পাতার রস দিয়ে নিজে হাতে ভাত রেঁধে রাজাকে খাইয়ে সারিয়ে তুলল। আর সারাতে সারাতে কিন্নর সেই রাজার প্রেমে পড়ল। রাজাও কিন্নরের সঙ্গে একটা মায়াতে জড়িয়ে পড়ল। তারপর দুজন দুজনকে ভালোবাসতে শুরু করল। রাজা বলল, ফকির না হলে যে ভালোবাসা যায় না, সেটা আমি আজ বুঝলাম। কিন্নর বলল, চলো ঘর বাঁধি। দুজন মিলে একটা মাটির কুটির বানিয়ে মহানন্দে থাকতে শুরু করল।  ওদিকে মন্ত্রী ভাবল, যতই হোক, ছিল তো রাজা-- আবার যদি সৈন্য সামন্ত জড়ো করে আক্রমণ করে বসে! তার চেয়ে একেবারে গোড়াতে শেষ করে দেওয়াই ভালো। মন্ত্রী লোক পাঠাল। এক রাতে রাজা আর কিন্নর চরম তৃপ্তিতে সঙ্গম করে দুজন দুজনকে জাপ্টে ধরে শুয়েছিল। ঠিক তখন মন্ত্রীর লোকেরা এসে ওদের কুটিরে আগুন দিল। দাউ দাউ করে জ্বলে গেল সব। আসতে আসতে আগুনও ঠান্ডা হল আর দুজনেই পুড়ে ছাই।  আগুন থেমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর একটা প্রবল ঝড় উঠেছিল। মনে হচ্ছিল যেন সব লন্ড ভন্ড করে দেবে।  আর সেই ঝড়ে আগুন পোড়া ছাইটা উড়তে শুরু করল। আমার ডানায় সেই ছাইগুঁড়োগুলো ছিটকে যেতে লাগল।  আর আমি ডানার সব রংগুলো হারিয়ে ফেললাম। ঝড় থেমে গেল কিন্তু আমার ডানাদুটো সেই থেকে ধূসর হয়ে গেল। সেদিন আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। শুধু ডানার রংটা হারিয়ে ফেললাম সেজন্য নয়। রাজা আর কিন্নরের জন্য। আমার চোখের সামনেই ওরা পুড়ে মারা গেল অথচ আমি কিছুই করে উঠতে পারিনি! তুমি তো জানো আসলে আমি কত ছোট, আমার কোনও ক্ষমতায় নেই। 

Comments

পাঠকের পছন্দ