শ্রেয়া চক্রবর্তী

কোয়ারেন্টিনের দিনগুলি

  
এক।


কাল সারা রাত ব্যাপক বৃষ্টি হল। বজ্র বিদ্যুৎ সহ।

আমার নদীর ধারে বাড়ি। বৃষ্টি হলে পৃথিবীকে এখানে যেন আদিম লাগে। আমি কল্পনা করি ঘন জঙ্গলের দিন। সেখানে বৃষ্টির জল ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো। আমি  আড়াল হই বুনো অশ্বত্থের তলে।

বজ্রপাতের শব্দ এখানে খুব প্রকট লাগে। মনে হয় যেন এই ঠিক আমার গায়ের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো। 

পুরনো বাড়ির খরখরি দেওয়া কাঁচের জানলায় বিদ্যুতের আলো লেগে ঘরের অন্ধকার মুহূর্তে আলোকিত হয়, পুনরায় সব অন্ধকার লাগে।

এমন কতবার । তবু কাল মনে হচ্ছিল এ বোধহয় কোন অশনি সংকেত । স্বর্গের দেবতারা রুষ্ট হলে পৃথিবীতে যে বার্তা আসে এ বোধহয় তাই।

তারপর মনে চলে গেল শূন্যে-

"Things fall apart; the centre cannot hold;

Mere anarchy is loosed upon the world,

The blood-dimmed tide is loosed, and everywhere   

The ceremony of innocence is drowned;"

এই ভরা বর্ষণের রাতে সুখী সেই যে কোন মহৎ প্রেমের ভেতর আছে। আশ্চর্য এই,  প্রেমকে আমি কোনদিনই ভীষণ নিরাভরণ করে ভাবতে পারিনি।

এই জীবন এই মৃত্যু এই সবই যেন প্রত্যাশিত। আকস্মিক বলে যা জেনেছি তা সেই রাজকীয় প্রেম ....

বিদ্যুতের আলোর মতো লহমায় সব আলোকিত করে নিমেষেই যে চির অন্ধকারে বর্জন করে

স্বার্থপরের মতোই মহাভিনিষ্ক্রমণে চলে যায় ...






দুই।



আমার ভেতরেও কোথাও একটা দেশভাগ হয়ে গেছে যেন। এপার আর ওপার।

দেশ ভাগের সময় যেমন রাতারাতি বহু মানুষকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল জন্মভিটে ছেড়ে কাঁটাতার টপকে ... হাতে ছিল কেবল এক পুটুলি । জীবনের আহরিত কত সম্পদ, প্রিয় মানুষের মুখ, ক্ষেত খামার, বাড়ির পুকুরে ভেসে থাকা মাছ সকলই স্মৃতি হয়ে গিয়েছিল । কতই না অন্তর্লীন রক্ত ক্ষরণ ও জীবন যুদ্ধের কষাগাতে ক্ষয় হতে হতে একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম । আমি সেদিনের সে সংগ্রামের শরিক ছিলাম না। আমি এমন কতই না সংগ্রামের শরিক হতে পারিনি।

আজ বুঝতে পারছি কোথাও আমার ভেতরেও একটা দেশভাগ ঘটে গেছে। এপার আর ওপার।

আমার জীবনের অর্ধেকটাই আমি ফেলে এসেছি অন্য কোথাও । আমার শৈশব, আমার বেড়ে ওঠা, আমার প্রথম যৌবনের স্মৃতি । আমার খেলাধুলো, আমার প্রথম প্রেম, আমার অজস্র বই এ ঠাসা আলমারি, প্রিয় চুড়িদার । আমার স্কুলের ডায়েরি, আমার নকশা কাটা গয়নার বাক্স, চুড়ি রাখার কাঠের স্ট্যান্ড। আমার রবীন্দ্ররচনাবলি, প্রেমিকের উপহার দেওয়া ফটোফ্রেম, পুরনো চিঠির দিস্তা।

তারপর একদিন, ঠিক একটি দিনের ব্যবধানে আমার এপার ওপার ঘটে গেছে। আমিও চলে এসেছি অন্য কোথাও, না পালিয়ে নয়, কাউকে ভালোবেসে বহুদূর,ওপার থেকে এপার  । না, ঠিক বহুদূরও বলা চলে না। দেশান্তর আমার ঘটেনি। দ্বীপান্তরও নয়। কেবল ভেতরে ভেতরে একটা পার্টিশন ঘটে গেছে। কারণ আমার অনেকটা আমিকেই আমি আজও নিয়ে আসতে পারিনি। যতটুকু আনতে পেরেছি সে কেবল আমার অর্জন । আমার তিলে তিলে গড়ে ওঠা আমি টুকুকে। এপারের নোনা হাওয়া যাতে লেগে ঘটে গেছে অনেক অদল বদল। কিন্তু যা কিছু আমার অধিক প্রিয় স্মৃতি দুচারটে ব্যাগ বোঝাই হয়েও তার যেটুকু বা মাত্র এপারে এসেছে, ওপারে রয়ে গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি ।

প্রতিটি মানুষই এক একটি আলাদা ভূখন্ড। যেই মাত্র একটি মানুষের হাত ছেড়ে অন্য আরেকের হাত ধরা হলো সে মাত্রই দেশান্তর। অথচ আমরা মেয়েরা কত সহজেই এটাকে স্বাভাবিক করে নিয়েছি। নিতে পেরেছি কারণ একটা কাঁধের ওপর আমাদের মোহ বড় বেশি ছিল, যা কাঁধ অতিক্রম করে অতি সহজেই একটি গোটা সংসারে তার শিকড় বাকড় গ্রন্হিত করতে দ্বিধান্বিত হয়নি। এই কারণেই তাকে তার স্মৃতি থেকে উৎপাটন করাও বোধহয় সহজ হয়েছে। ছেলেরা আঁকড়ে ধরে কম। কারণ প্রথম থেকেই তার বিচরণের ক্ষেত্রটি অসীম। আর মেয়েরা একটু ভালোবাসা পেলে কিই না করতে পারে তার ছোট্ট সীমার ভেতর!

আমার এই এপার আর ওপারের মধ্যে আজ কোন কাঁটাতার নেই । যা আছে তা হলো কেবলই এক মানুষ নিয়ন্ত্রিত সময়ের সীমারেখা। যা আছে তা হলো লকডাউন, কার্ফু। আজ আমি চাইলেই যেখানে যেমন খুশি বিচরণ করতে পারিনা। আজ আমি সন্দীহান যে সীমার ওপারে আমার চলাচল আমার স্বেচ্ছার অতিরিক্ত অন্য কোন শর্তে নিয়ন্ত্রিত হয় সে দেশ আদৌ আমার কিনা।

এই সব কিছুর শেষে আমি নিজেকেই খুঁজে বেড়াই। তবে এপারের আমি? নাকি ওপারের আমি? নাহ্ । কোনটাই নয়। আমি ততটুকুই যতটুকু এ জীবন আমি আমার মাথার ভেতর ধারণ করতে পেরেছি। সেটুকুই অর্থবহ। বাকি যেখানে যা পড়ে আছে সে সবই অতিরিক্ত । ওসবে আজ আমার কোন প্রয়োজন নেই।





তিন।



মাটির অনেক গভীর থেকে উঠে আসা শেকড় বাকড় বুনো লতা ক্রমশ আমাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলতে চাইছে যেন মাটির সাথে

কিছুতেই ছাড়িয়ে উঠতে পারছি না এমন বাঁধুনি

মরার মত শুয়ে থেকে কেবল ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে চেয়ে আছি

দেখছি দিন গিয়ে রাত আসছে রাত ফিকে হচ্ছে ভোরে 

অরণ্যের গভীরে অদ্ভুত জীব জন্তুরা ডেকে উঠছে

দূরের নদীতে পাথরে লেগে জলের কলকল শব্দ  

আরও কিসের গুঞ্জন বুনো ঘাসে?

অথচ কেউ আমার ধারে কাছে অবধি নেই

কি অদ্ভুত এই বেঁচে থাকা 

এত মন খারাপ সাথে নিয়ে আমি চলে যেতে চাই না

Comments

পাঠকের পছন্দ